গতকাল সকালে যখন মানবজমিনের জন্য এই কলাম লিখছি ততক্ষণে বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপূজার চতুর্থীর বাজনা বেজে উঠেছে। দু’বছর ভয়াবহ পান্ডেমিকের কারণে দুর্গাপূজা নম নম করে শেষ করা হলেও এবার কলকাতা আবার সেই কলকাতায় ফিরেছে। বিশাল বিশাল মণ্ডপ আর আলোকসজ্জা, থিম পুজোয় নানা কিসিমে আর বহুমুখী আইডিয়ার পুজো, বিরাট বিরাট মূর্তি, দর্শনার্থীরা বেরিয়ে পড়েছেন বুধবার তৃতীয়ার রাত থেকেই। রাস্তায় রাস্তায় যানজট। মুখ্যমন্ত্রী কোনো পুজোর উদ্বোধন করে ঢাক বাজাচ্ছেন, কোথাও আবার রং-তুলি হাতে তুলে নিচ্ছেন। কলকাতার পুজোর সেই গ্রাঞ্জার, সেই রৌনক ফিরে এসেছে।
বাঙালি তাদের সেরা উৎসব ফিরে পেয়েছে। কিন্তু রাজনীতি যেন এই পুজোর মওসুমেও তাদের কাঁধে সিন্দাবাদের নাবিকের মতো চেপে বসেছে। বলিউড তারকা মিঠুন চক্রবর্তীকে দিল্লির বিজেপি নেতৃত্ব এই পুজোয় জনসংযোগ করতে পাঠিয়েছে। তিনি পুজোর উদ্বোধনের ভাষণেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি হুঙ্কার ছাড়ছেন যে, ডিসেম্বরেই রাজ্য সরকার পড়ে যাবে। ১৮ জন তৃণমূল বিধায়ক তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সংখ্যাটি আরও বেশি, কিন্তু যেহেতু দিল্লি বেনোজল ঢোকাতে চাইছে না, তাই তারা ১৮তেই সীমাবদ্ধ থাকছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পাল্টা দিচ্ছেন। পুজো উদ্বোধনে গিয়েও তার মুখে বিজেপি’র চক্রান্তের কথা। একডালিয়া এভারগ্রিনে গিয়ে তিনি তো স্পষ্ট বলেই দিলেন, পুজোর প্রাণপুরুষ সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর অন্যতম কারণ, বিজেপি দ্বারা প্রেরিত কেন্দ্রীয় এজেন্সির অপমান। ঢাকের বোলে যত কাঠি পড়ছে ততো যেন পুজো উপলক্ষে বিভাজন ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। তৃণমূল নেতা মদন মিত্র তো মহালয়ার তর্পণ করলেন শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষের ছবিতে মালা পরিয়ে। তৃণমূল জীবিত মানুষের গলায় তর্পণের মালা পরানোকে যতই নিম্নরুচির স্ট্যান্ট বলে চিহ্নিত করুক তারা নিজেরা পুজো নিয়ে কি করছে! বিজেপিই বা পুজো উদ্বোধনে মমতার অংশগ্রহণকে ব্যঙ্গ করেও নিজেরা এই পুজো নিয়ে কী করছে! বাঙালির আবেগ যেহেতু জড়িয়ে আছে এই পুজোর সঙ্গে অতএব ভোট ব্যাংককে প্রভাবিত করার সুযোগ কে ছাড়ে? তাই, তৃণমূলের পুজো, বিজেপি’র পুজো বলে এবারের সর্বজনীনগুলো চিহ্নিত। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় বলে তাদের পুজোর সংখ্যা ঢের বেশি। সে তুলনায় বিজেপি’র পুজো কম। তাও অমিত শাহকে ইজেডসিসির বিজেপি’র দুর্গাপুজোয় আনার চেষ্টা হচ্ছে। বিজেপি নেতা সজল ঘোষের সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোতেও যেতে পারেন। কিন্তু ফিরহাদ হাকিমের চেতলা অগ্রণীর পুজো কিংবা অরূপ বিশ্বাসের সুরুচি সংঘের পুজোয় তিনি পা রাখবেনÑ এমনটা কল্পনা করা যায় না। যেমন কল্পনা করা যায় না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোর উদ্বোধন করতে লেবুতলা পার্কে গেছেন! আসলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, ঘটি-বাঙাল, উত্তম-সৌমিত্র, চিংড়ি- ইলিশের মতো মাও দু’ভাগ হয়ে গেছেন। কোথাও মা দুর্গা তৃণমূলের, কোথাও আবার বিজেপি’র। বাম আমলে এই বিভাজন চোখে পড়েনি। মূর্তি পুজোর বিরোধী বামেরা লুকিয়ে লুকিয়ে যতই পুজোর পৃষ্ঠপোষকতা করতো, প্রকাশ্যে তারা মণ্ডপের পাশে লাল শালু দিয়ে তৈরি বইয়ের স্টল বসিয়েই ক্ষান্ত থাকতো। এবার পুজোর তোরণেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ, মুষ্টিমেয় তোরণে নরেন্দ্র মোদিও হাজির। শহরে পুজোয় নীল-সাদা দোতলা বাস চলছে ট্যুরিস্টদের জন্য। বাস চলছে ভালো কথা। দোতলা বাসকে স্বাগত। কিন্তু রংটা নীল সাদা না হয়ে সাবেক দোতলা বাসের লাল কিংবা নীল রং হতে পারতো না? দূর মশাই, প্রচারের এই দুনিয়ায় তৃণমূল কেন নিজেদের ট্রেডমার্ক নীল সাদা ছাড়বে? হতে পারে পুজো, কিন্তু পুজো তো চারদিনের আর তৃণমূল দলটা তো আবহমান, তাহলে? বিজেপি’র শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার কিংবা দিলীপ ঘোষরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বোধন নিয়ে চোখা চোখা বুলি ছাড়ছেন, যেন তারা ক্ষমতায় এলে উদ্বোধনে যাবেন না! আঙ্গুর ফল তো টকই হয়! কৈলাশে শিবশম্ভু দেবী দুর্গাকে মর্ত্যতে যাওয়ার আগে বললেন, তোমার পুজোকেও ওরা ছাড় দিলো না গো, দেবী দুর্গাতেও তৃণমূল-বিজেপি। দেবী দুর্গা মর্ত্য ভ্রমণের আগে মুখে ফাউন্ডেশন লাগিয়ে চুপ করে বসেছিলেন। এবার ঘুরে গ্রিবাভঙ্গি করে শিবকে বললেন, মরণ আমার! ওরা বাঙালি নয়? বঙ্গ সন্তানরা কবে আর দলবাজি, কাঠিবাজি ছেড়েছে? বাঙালিকে তুমি নতুন চিনছো কী দেবাদিদেব!