ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

কেন রাষ্ট্র আকবর আলি খানকে যথাযথ সম্মান দেয়নি

কাজল ঘোষ
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, শনিবার
mzamin

ভারত ও পাকিস্তান বরাবরই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। দৃশ্যত বিরোধিতাই চোখে পড়ে। কিন্তু একটি ঘটনা জানা এই দৃশ্যপটকে একেবারেই উল্টে দেবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন পণ্ডিত জওহরলাল নেহ্‌রু।  অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূন। নেহেরুর  আমন্ত্রণে ফিরোজ খান নূন যান ভারত সফরে। সঙ্গে পত্নী ভিকারুননিসা নূন। পিআইয়ের বিশেষ বিমানে পালাম বিমানবন্দরে নূন অবতরণ করলে নেহেরু তাকে স্বাগত জানান। আলোচিত এই সফরে নেহেরু প্রটোকল ভেঙে বিমানের গ্যাংওয়েতে গিয়ে এই দম্পতিকে উষ্ণ আথিতেয়তায় বরণ করেন। বিমান অবতরণ করলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নূন আর ভিকারুননিসা পাশাপাশি নামছিলেন।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু সিঁড়ি থেকে নামার কয়েক ধাপ আগেই ভিকারুননিসার এক পাটি জুতা পা থেকে নিচে পড়ে যায়। বহু রকমের নিরাপত্তা কর্মীরা বিমানটি ঘিরে আছে। সকলকে অবাক করে দিয়ে সিঁড়ির নিচ থেকে জুতাটি তুলে আনেন স্বয়ং নেহেরু। চারপাশের নিরাপত্তাকর্মী ও দু’ দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা যেমন অবাক হয়েছেন এ ঘটনায়; তেমনি হতবাক হয়েছেন ফিরোজ খান নিজেও। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। দু’দেশের সকল স্তরের কর্মকর্তাদের বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন তারা দেখলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিচু হয়ে বেগম নূনের পায়ে জুতা পরিয়ে দিয়েছেন। 

ভিকারুননিসা নূনের পায়ে জুতা পরিয়ে দিয়ে জওহরলাল নেহেরু কি ছোট হয়েছেন না চরম সৌজন্যবোধ ও শিষ্টাচারের পরিচয় দিয়েছেন? ফিরি দেশের মাটিতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানী দুজনই প্রয়াত। রাজনীতির মাঠে তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও এই দু’নেতার মধ্যে শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ ছিল কিংবদন্তি পর্যায়ে। ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক তখন কাজী জাফর আহমদ। সামনে ঈদ। কাজী জাফর বহু খোঁজাখুঁজি করে মওলানা ভাসানীর জন্য তার পছন্দের পোশাক কিনেন। সঙ্গে ভাসানী পত্নীর জন্যও। ঈদের আগের দিন ভাসানীর বাড়িতে সেই পোশাক নিয়ে যান কাজী জাফর নিজে। পোশাক দেখে খুশি হন ভাসানী। আর মুখে বলেন, তোমার দেয়া পোশাক ঈদের দিন বিকালে পরবো। কথা শোনে কাজী জাফর তো থ’ মেরে যান। এত খোঁজাখুঁজি করে আনা পোশাক মওলানা ভাসানী পরবেন বিকালে তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। জাফরের ইচ্ছা এই পোশাক পরে মওলানা ভাসানী ঈদের জামাতে যাবেন। একপর্যায়ে ভাসানীর কাছে বিকালে এই পোশাক পরার কারণ জানতে চান। ভাসানী তাকে জানান, ঈদের জামাতে যাবো মুজিবুরের পোশাক পরে। রাতেই মুজিবুরের পোশাক পেয়ে যাবো। তাজ্জব বনে যান কাজী জাফর। বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আপনি রাজপথে আন্দোলন করছেন। তার সরকারের সমালোচনা করছেন। আর তার দেয়া পোশাক পরে আপনি ঈদের জামাতে যাবেন? মওলানা ভাসানী তখন কাজী জাফরকে বলেন, শোন জাফর, শুধু কালকের ঈদই নয়, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে মুজিবুরের দেয়া পোশাক পরে আমি ঈদের নামাজ পড়ি। 

পাকিস্তান আমলে মুজিবুর জেলে থাকলেও তার স্ত্রী ঈদের পারিবারিক বাজারের সঙ্গে আমার পোশাক কিনতে ভুলতো না। যথারীতি ঈদের আগের রাতে সেই পোশাক আমার কাছে পাঠিয়ে দিতো সে।  দুটি ঘটনার কথা বারবার মনে হচ্ছে সদ্য প্রয়াত ড. আকবর আলি খানের মৃত্যুর পর থেকেই। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে কোনো শোকবার্তা আসেনি। টেলিভিশন স্ক্রল বা পত্রিকার পাতায় তা চোখে পড়েনি। স্বাভাবিক কারণেই জনমনে প্রশ্ন ড. আকবর আলি খান কেন এই শোকবঞ্চিত হলেন। রাষ্ট্রে শীর্ষ পর্যায় থেকে গুণী ও বিদ্বগ্ধ এই মানুষটির প্রতি শোক জ্ঞাপনে কেন এত কার্পণ্য? তিনি কি এমন অপরাধ করলেন?  একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন হবিগঞ্জের এসডিও। একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবে তিনি তার এখতিয়ারের বাইরে কি-না করেছেন? তদানীন্তন মহকুমার অস্ত্রাগারের ভল্ট খুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। খাদ্যগুদাম খুলে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্থ নিরন্ন মানুষের জন্য। ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা তুলে দিয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের হাতে। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে।

 একাই তিনি ছিলেন মুক্তি সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক। তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার চৌদ্দ বছরের সাজাও দিয়েছিল। কিন্তু অকুতোভয় আকবর আলি খান পিছপা হননি। জীবন বাজি রেখে লড়েছেন।  স্বাধীনতার পর আকবর আলি খান যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায়। ইচ্ছা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন। সরকারি কর্মকর্তার পদ থেকে তিনি ছুটি চাইলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। আবেদন বঙ্গবন্ধুর নজরে এলে তিনি ডেকে পাঠান আকবর আলি খানকে। বললেন, তোমার মতো কর্মকর্তার দরকার আছে সরকারের। সুতরাং ছুটি হবে না, কাজে যোগ দাও। নিজের স্বপ্নকে দূরে রেখে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যোগ দেন সরকারের আমলা হিসেবে। একের পর এক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি দপ্তরেই।  সরকারের শীর্ষ আমলার পদে উন্নীত হয়ে অবসরে যান তিনি। কিন্তু দমে যান নি। ডাক আসে দেশের সংকটময় মুহূর্তে। দেশে তখন তীব্র অচলাবস্থা। রাজনীতির মাঠ দু’ শিবিরে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ একদিকে লগি বৈঠা নিয়ে, অন্যদিকে বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে টালবাহানায় দেশের রাজপথ উত্তপ্ত। ২০০৬ সালের ১১ই জানুয়ারি আসে ইয়াজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। 

সে সরকারের অংশ হন ড. আকবর আলি খানও। তিনি ছিলেন  জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হন। ইয়াজউদ্দিন সরকার চলমান সঙ্কটের সুরাহা করতে পারেনি। দেশের মানুষ তখন তাকিয়ে আছে উপদেষ্টা পরিষদ কী করছে সেদিকে। প্রায় প্রতিদিনই খবরের শিরোনাম হচ্ছেন ড. আকবর আলি খানসহ অন্য উপদেষ্টাগণ। আড়ালের নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে ড. আকবর আলি খানের নেতৃত্বে আরও তিন উপদেষ্টা জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী, সি এম শফি সামী ও এডভোকেট সুলতানা কামাল পদত্যাগ করলেন। চার উপদেষ্টার পদত্যাগে সে সময়ের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায় রাতারাতি।    ড. আকবর আলি খান তার পদত্যাগের  যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বিবৃতিও দিয়েছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি সেই বিবৃতিতে বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবদান রাখার কোনো সুযোগ নেই। আফসোস থেকেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। চার উপদেষ্টার পদত্যাগে জল গড়ায় অনেকদূর। গঠিত হয় নতুন উপদেষ্টা পরিষদ। নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের দোলাচল চলছিল তা কেটে যায়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয়।

 তারপরের ঘটনা তো কারও অজানা নয়। সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। রাজনীতির মাঠে বলাবলি আছে, সেদিন যদি ড. আকবর আলি খানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে চার জন সরে না দাঁড়াতেন তাহলে রাজনীতির ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো।  ন্যায়নিষ্ঠ ও স্পষ্টবাদী মানুষ ড. আকবর আলি খানের বিবেকের কণ্ঠ থামেনি। ক্ষমতার অংশীজন বা ক্ষমতার বাইরে থাকলেও যেখানেই ছিলেন শেষ পর্যন্ত তিনি গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানুষের ভোটাধিকার প্রশ্নে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। দেশের চলমান যেকোনো সংকটে সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। প্রশ্ন থাকে, জনমানুষের পক্ষে অবস্থান নেয়াই কি রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রয়াত এই মানুষটির জন্য কোনো শোকবার্তা আসেনি। শুধু পক্ষে থাকলেই সব ঠিক আর যদি তা ন্যায়ের পক্ষে হয়, মানুষের পক্ষে হয়- তা বললে কি ঠিক নয়? এই যদি নীতি হয় তাহলে আমাদের সমাজ থেকে সৌজন্যতাবোধ ও শিষ্টাচার কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?  লেখাটির ইতি টানতে চাই দুজন মনীষীর কথা বলে। রুশো ও ভলতেয়ারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। দুজন ছিলেন একেবারেই দু’মেরুর।

 একজন নগর সভ্যতার পক্ষে আর অন্যজন প্রকৃতির পক্ষে। রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্ট বইটি নিয়ে দুনিয়াজুড়ে হইচই। কিন্তু প্রতিপক্ষের মত তার বিরুদ্ধে গেলেও সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য  বরাবরই সোচ্চার ছিলেন এই দার্শনিক। নানান বিষয় নিয়ে রুশো ও ভলতেয়ারের মধ্যে বিতর্ক হতো। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধ মতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে রুশো বলেছিলেন, আমার বিরোধীপক্ষের মতের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি। আমরা আছি কোথায়? আমাদের এখানে সবকিছুই কি দলীয় বিবেচনায়? সেখানে পারস্পরিক সৌজন্যতাবোধ একেবারেই কি বিলুপ্ত? স্বশ্রদ্ধ প্রণতি ও বিনম্র শ্রদ্ধা সদ্য প্রয়াত ড. আকবর আলি খানের প্রতি। দেশের মানুষ আপনার কীর্তি ও কর্ম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status