মত-মতান্তর
প্রবীণের চাহিদা-সঙ্কট ও সম্ভাবনা
হাসান আলী
(২ বছর আগে) ২ সেপ্টেম্বর ২০২২, শুক্রবার, ১২:৫৭ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:৩০ পূর্বাহ্ন

প্রবীণ কারা? জাতিসংঘের মতে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের ষাট বছরের বেশি বয়সীরা প্রবীণ। উন্নত দেশ গুলিতে পঁয়ষট্টি বছরের অধিক বয়সীরা প্রবীণ। বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ প্রবীণ। ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি পাঁচ জনে একজন মানুষ প্রবীণ হবেন। আর আমরা বেঁচে থাকলে বার্ধক্যকে অবশ্যই বরণ করতে হবে।
প্রবীণের চাহিদা কি? ভাল বিছানা, সুস্বাদু খাবার, পরিষ্কার কাপড় চোপড়, চিকিৎসা সেবা, নিয়মিত ঔষধ পত্র, যত্ন আত্তি পাওয়া, আত্মীয় স্বজনকে দেখা, মর্যাদা সম্মান পাওয়া, যে কোন বিষয়ে মতামত দেয়া, ধর্মকর্ম করা, বেড়াতে যাওয়া, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে যাওয়া ইত্যাদি।

প্রবীণের সংকট কি? প্রথমত: প্রবীণের শারীরিক সংকট। যেমন চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা, সারা শরীরে ব্যথা, উচ্চ রক্ত চাপ, প্রস্রাবের সমস্যা- ডায়েবেটিস, বাতের ব্যথা, মাথা ঘোরা-ঝিম ঝিম করা, শরীরে চুলকানি, শরীর খসখসে হওয়া, ঘনঘন পড়ে যাওয়া, কোষ্ঠ কাঠিন্য, হার্টের সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, রক্তে চর্বি বেড়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া, খাবারে রুচি না থাকা, পেট ফাঁপা বুকজ্বালা ইত্যাদি। প্রবীনরা গড়ে পাঁচটি রোগ বহন করে। কারো কারো আরও বেশি রোগ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত: প্রবীণের মানসিক সংকট, আর্থিক সামর্থ্য না থাকা, সমাজে পরিবারে গুরুত্ব না পাওয়া, রাগ বেড়ে যাওয়া, নালিশ করার প্রবণতা, একাকীত্ব, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন- কথা বেশি বলা, নিজকে পরিবারের বোঝা মনে করা, পরিবারের সদস্য কর্তৃক অপমান, অবহেলা, গালাগালি ইত্যাদি।
প্রবীণ নিজে মানতে চায়না তাঁর শারীরিক বয়স হয়েছে। বয়সের কারণে তাঁর নানা ধরনের রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। প্রবীণ বলবে, 'আগে আমার কোন রোগ ছিল না, আমি ভালই ছিলাম।' প্রবীণের শারীরিক সংকট নিরসনে ডাক্তার হাসপাতালের সহযোগিতা নিতে হবে। অবহেলা বা দেরি করলে প্রবীণ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। চিকিৎসা ও ঔষধপত্র ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্কতার আশ্রয় নিতে হবে। প্রবীণ ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যকর পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। প্রবীণ বয়সে পুরুষ ৬০০ ক্যালোরী এবং নারী ৩০০ ক্যালোরী খাবার কম গ্রহণ করবেন। শরীরের যত কেজি ওজন তত গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। ধরুন কারো ওজন ৬০ কেজি, তিনি ৬০ গ্রামের বেশি প্রোটিন খাবেন না। বেশি পরিমাণ প্রোটিন গ্রহণ করলে লিভার এবং কিডনীর উপর চাপ বাড়ে। আবার কেউ যদি পরিমাণে কম প্রোটিন গ্রহণ করেন তাতে শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান যে সব প্রবীণ শারীরিকভাবে অৰম, চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁদের সেবা যত্ন ঠিকমত হয় না। কাপড় চোপড়-বিছানা পত্র পরিষ্কার থাকে না। অনেক সময় দুর্গন্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করে। প্রবীণ মানুষের ঘ্রাণ শক্তি কমে যায় বলে দুর্গন্ধ বুঝতে পারেন না। আামদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা প্রবীণকে সব চাইতে নিম্ন মানের জায়গায় থাকতে দেই। যে রুমটায় আলো-বাতাস কম গরম সেই রুম হয় প্রবীণের থাকার জায়গা। গ্রামে দেখেছি প্রবীণের থাকার ঘরটি পুরানো নড়বড়ে, ঘুন পোঁকার ময়লা, মাকড়সা, মশা মাছিতে ভরপুর। অনেক প্রবীণকে দেখেছি বারান্দায় থাকে যার একপাশ খোলাই থাকে। প্রবীণ শীত গরম দুটোর কোনটাই সহ্য করতে পারে না। শীতেও কষ্ট পায় আবার গরমেও কষ্ট পায়।
দ্বিতীয়তঃ প্রবীণের মানসিক সংকট তৈরি হয় নানা কারণে। যেমন মানসিক চাপ, চাহিদা মেটাতে না পারা, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, পরিবারে খবরদারি করতে না পারার জন্য। প্রবীণ বয়সে মানুষের আয় কমে যায়। অনেকেরই কোনো আয় থাকে না। ছেলেমেয়েদের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। অনেক কিছু ভুলে যায়। নিকটতম ঘটনা মনে রাখতে পারে না। স্নায়ু তন্ত্রের ৰমতা প্রায় ৪০ ভাগ হরাস পায়। নিজের উপর অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনা। আবার কেউ কেউ খুবই অভিমানী হয়ে উঠেন। প্রবীণ নারী অনেকটা কতৃত্ব পরায়ন হয়ে উঠেন। এভাবেই প্রবীণ শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে পড়েন। এরকম সংকটকালে প্রবীণ অনেক সময়ই কাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে পারেন না। সাম্প্রতিক কালে প্রবীণের আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। প্রবীণ বিধবারা সবচাইতে বেশি সমস্যায় রয়েছেন।
প্রবীণের সম্ভাবনা কি? যিনি বুড়ো হয়েছেন তাঁর আবার সম্ভাবনা কি? প্রবীণের মধ্যে অবশ্যই সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবীণ মাত্রই সব কিছু শেষ তা নয়। দীর্ঘ জীবনে প্রবীণ নানা সংকট মোকাবেলা করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। জীবনে সাফল্য যেমন লাভ করেছেন তেমনি ব্যর্থতা রয়েছে অনেক। জীবন থকে প্রবীণ অনেক কিছু শিখেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার অনেক বড়। তাঁর মতামত পরামর্শ অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। প্রতিটি পাড়ায় মহলস্নায় প্রবীণরা একত্রিত হয়ে সংগঠন করতে পারেন। এতে করে তাঁদের দাবি দাওয়া সরকারের কাছে পৌঁছানো সহজ হবে। জনপ্রতিনিধিরা প্রবীণদের গুরুত্ব দিবেন কারণ তাঁরা মূল্যবান ভোটার। প্রবীণের জন্য কল্যাণকর কর্মসূচি নিতে জনসচেতনতা বাড়ানো যায়। আজকের যুগে নারী পুরুষ উভয়ই কর্মৰেত্রে ভীষণ ব্যসত্দ হয়ে পড়েছেন। বাড়িতে ছোট ছেলে মেয়েদের দেখার জন্য নির্ভরযোগ্য কেউ থাকেন না। প্রবীণ এই দায়িত্বটি সুচারূভাবে পালন করতে পারবেন। সংসারের ছোট খাট কাজকর্ম করে পরিবারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রবীণ সংসারের বোঝা নয় সম্পদ। আজকাল গ্রামে গঞ্জে শহর-বন্দরে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে। প্রবীণরা সংগঠিত হলে তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ নিরসনে মধ্যস্থতাকারী হতে পারেন। শিৰা বিসত্দারে, সামাজিক সচেতনতায় প্রবীণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রবীণরা বিশ্বসত্দ হন। তাঁদের উপর নির্ভর করা যায়। প্রবীণরা দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকেন না। জীবনের শেষ পর্যায়ে সবাই ভাল কাজ করতে চায়, মানুষের কাছ থকে স্বীকৃতি পেতে চায়। বেশির ভাগ প্রবীণই সৎ,দৰ যোগ্য, আদর্শবান হয়ে থাকেন। প্রবীণের যুক্তি নবীনের শক্তি সমাজকে এগিয়ে নিতে প্রধান ভূমিকা পালন করবে।