মত-মতান্তর
এতো বিরোধীতা, তবুও কেনো ইভিএমে ইসি?
সাংবাদিক হাসান আল বান্না
(২ বছর আগে) ২৪ আগস্ট ২০২২, বুধবার, ৫:২৫ অপরাহ্ন

দেশের নিবন্ধিত ৭০ শতাংশের বেশি রাজনৈতিক দলের তীব্র বিরোধীতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ২৩শে আগস্ট নির্বাচন কমিশন সম্ভাব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেড়শ’ আসনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে নতুন করে আরেক দফা বিতর্কে জড়ালো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থাটি। ইভিএম যাবে ব্যভহার করা না হয় যেজন্য মিছিল-মিটিং সভা-সেমিনার হয়েছে। কিন্তু ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জোড়ালো মতামত থাকলেও তারা তো আর এই যন্ত্র ব্যবহারের পক্ষে রাস্তায় নেমে দাবি জানায়নি। তারপরও কেনো ২৩শে আগস্ট কমিশন সভায় ইসিকে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো? কার স্বার্থে ইসি এমন সিদ্ধান্তে আসলো, এমন প্রশ্ন এখন সর্বত্র।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ করা হবে কিনা তা ঠিক করতে গতমাসে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে সংলাপে আহ্বান করে নির্বাচন কমিশন। ইভিএম নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রিত নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অংশ নেয়নি বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও নাজিউর রহমান মঞ্জু’র প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। অর্থ্যাৎ মোট রাজনৈতিক দলের ২৮ শতাংশের বেশি দল ইসির সংলাপকেই পাত্তা দেয়নি। মানে এই দলগুলো ইভিএম নিয়ে আলোচনা করতেই রাজি হয়নি। আরা যারা ইসির সঙ্গে ইভিএম ইস্যুতে আলোচনা করতে সংলাপে বসেছিলেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি প্রশ্নহীনভাবে ইভিএমের পক্ষে অবস্থান নেয়। এছাড়া আওয়ামী লীগ জোট ও জোটের বাইরে থাকা আরও সাতটি রাজনৈতিক দল সন্দেহ, সংশয়, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতার কথা উল্লেখ করে কিছু কিছু কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষ মত দিয়েছিলো। প্রশ্নহীনভাবে চারটি এবং সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস নিয়ে আরও সাতটি দল ইভিএমের পক্ষ অবস্থান নিয়েছে। অর্থ্যাৎ এরা দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মোট ৩০ শতাংশেরও কম। অপরদিকে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সঙ্গী এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ ৭২ শতাংশ রাজনৈতিক দলই ইভিএমের সম্পূর্ণ বিরোধী। এছাড়া অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক ঐক্য, নাগরিক অধিকার পরিষদ, লেবার পার্টিসহ অনিবন্ধিত আরও যেসব রাজনৈতিক দল রাজপথে সক্রিয় রয়েছে তারাও ইভিএম মেশিন ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। শুধু নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পরিসংখ্যান মেলালে দেখা যায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা আরও তিনটি দল সিরিয়াসলি ভোটে ইভিএম চায়। ৩৯ টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে এরা মাত্রা ১০ শতাংশ। আর সামগ্রিকভাবে বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইভিএম চাওয়ার পরিমাণ আরও কমে। তাহলে কেনো নির্বাচন কমিশনকে এমন সিদ্ধান্ত নিতো হলো।
কমিশন কী অভ্যন্তরীণ কোনো চাপে এমন বিরোধীয় বিষয়টি নিজেদের ঘাড়ে নিল নাকি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে ঠিক কী ধরণের প্রতিক্রিয়া হয় তা আন্দাজ করতে এমন সিদ্ধান্ত নেয় তা বোধগম্য নয়। দেশের প্রায় সব শ্রেণী পেশার লোকজন এটা ভালোভাবেই জানেন ‘ইভিএমে ফলাফল পাল্টানোর সুযোগ রয়েছে,’ তাছাড়া আইটি বিশেষজ্ঞরা এমন মতামত অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন। বিতর্ক ওঠায় উন্নত অনেক দেশ ইভিএম থেকে সরে এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো দেশের বেশিভাগ মানুষেরও ইভিএম এর ওপর আস্থা নেই। এরপরও কেনো ইসিকে ইভিএমে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো? সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, ইসি কী বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা বাস্তবায়নে কাজ করছে?
নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার করা হবে কিনা তা নির্ধারণে গত ১১ই আগস্ট কমিশন একটি সভা ডেকেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু পরে সেই সভাটি হয়নি। ২৩শে আগস্ট সভা ডেকে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য এরআগেই নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ২১শে আগস্ট রোববার নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের অগ্রিম জানিয়ে রাখেন। কমিশনের এমন সিদ্ধান্তে ‘নির্বাচন কমিশন যে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণে আন্তরিক নয়,’ সেটাই মনে করছেন নাগরিক সমাজের লোকেরা। তারা মনে করেন, ইভিএম জালিয়াতির মেশিন। এ মেশিনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না। নিয়ন্ত্রিত এ মেশিনে ইসি যেভাবে চাইবে সেভাবে ফলাফল প্রকাশিত হবে।
দেশের ৭২ শতাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কঠোর বিরোধীতার মধ্যেও ইসি আগামী নির্বাচেন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত অটল থাকলে শুধু রাজনৈতিক দলেরই নয়, সাধারণ মানুষেরও আস্থা হারাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও বিশ্লেষক