মত-মতান্তর
দুর্নীতির 'লালসালু'
ড. মাহফুজ পারভেজ
(২ বছর আগে) ২০ আগস্ট ২০২২, শনিবার, ১১:২১ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০১ পূর্বাহ্ন

'লালসালু' সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত অভিষেক উপন্যাস। ১৯৪৮ সালে রচিত এবং প্রকাশিত উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টিকর্ম হিসেবে বিবেচিত। এর পটভূমি ১৯৪০ কিংবা ১৯৫০ দশকের বাংলাদেশের গ্রামসমাজ হলেও এর প্রভাব বা বিস্তার কালোত্তীর্ণ। মূলত গ্রামীণ সমাজের সাধারণ মানুষের সরলতাকে কেন্দ্র করে ধর্মকে ব্যবসার উপাদানরূপে ব্যবহারের একটি নগ্ন চিত্র উপন্যাসটির মূল বিষয়।
ধর্মীয় দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি অনবদ্য লেখা আছে শিবরাম চক্রবর্তীর। গল্পের নাম ‘দেবতার জন্ম’, যার কাহিনী নিম্নরূপ:
যাওয়া-আসার রাস্তায় উঁচু হয়ে থাকা একটা পাথর; হোঁচট খাওয়া এড়াতে তাকে এক কোণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক দিন কেউ এসে তার গায়ে তেল-সিঁদুর দিয়ে পুজো করতে শুরু করল। অচিরেই সেটি স্বপ্নে পাওয়া ‘জাগ্রত’ শিবলিঙ্গের মর্যাদা পেল, তাকে ঘিরে মন্দির উঠল, ভক্ত সমাগম হল, শেষ পর্যন্ত যিনি রোজ হোঁচট খেতেন তিনিও সেই দেবতার মাহাত্ম্যে বিশ্বাস করে ফেললেন। ।
আজ সর্বব্যাপী দুর্নীতির উৎস সন্ধান করতে গিয়েও এসব গল্পের কথা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। আশির দশকে 'দুর্নীতি উল্লাস' মিডিয়ায় আইকনিক খবরে পরিণত হয়েছিল, তা এখন মহোৎসব। বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা৷ এই অর্থ বাংলাদেশের দু'টি বাজেটের সমান। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।
গত ২ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। বলা হয়েছে, আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ভয়েস এবং ওভার ভয়েসের মাধ্যমেই প্রধাণত এই অর্থ পাচার করা হয়। প্রতিবেদনে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। পরবর্তী বছরগুলোতে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ আরো বেড়েছে বলেই তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।
গত এক দশকে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত দুটি শব্দ হলো কানাডার বেগমপাড়া। যদিও এ নামে কোন এলাকা নেই তারপরেও বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন পথে টাকা নিয়ে যেসব এলাকায় কিছু বাংলাদেশি ঘরবাড়ি কিনেছেন সেগুলোরই পরিচিত গড়ে উঠেছে বেগমপাড়া হিসেবে।
আরো খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, অর্থপাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশিরা যেসব দেশে বাড়ি করেছেন, সেসব দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া অন্যতম। মালয়েশিয়া সরকারের ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা, রাজনীতিবিদসহ কয়েক হাজার নাগরিক নাম লিখিয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা ও প্যারাডাইস পেপার আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে আকসার লেখালেখি ও গবেষণা করছে। এসব তথ্য প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ হলেও আর্থিক দুর্নীতি তথা পাচার বন্ধে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। ফলে দিনেদিনে দুর্নীতির 'লালসালু' প্রলম্বিত হয়েছে। আর্থিক থেকে নৈতিক, রাজনৈতিক থেকে প্রশাসনিক, উচ্চ থেকে নিচু স্তরের সর্বস্তরে প্রসারিত হয়েছে দুর্নীতির রাহুগ্রাস। যে বা যারা যেখানেই ক্ষমতা বা সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই নানা আকার ও প্রকারের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে দেদারে মাল কামিয়ে নিচ্ছে।
আগে কোথাও কোনো কাজের জন্য কেউ কিছু চাইতেন না। চা-মিষ্টি-বকশিশ বলেও কিছু ছিল না। এসব না থাকলেও কাজ করতে কারো কোনো অসুবিধাও হয়নি। পরবর্তী কালে প্রথমে শুরু হলো মিষ্টি খাওয়া। অচিরেই তা পরিণত হল বকশিশে। তারপর ‘চেয়ে নেওয়া’ও শুরু হল। আজ কোটি কোটি মুদ্রা গোনা হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। চাকরি, ভর্তি, টেন্ডার, নির্মাণ, চিকিৎসা, থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা, কোথায় নেই আর্থিক দুর্নীতি। একটু একটু করে দুর্নীতির জন্ম ও বংশবৃদ্ধি হতে হতে তা পরিণত হয়েছে বিষবৃক্ষে এবং অক্টোপাসের মতো 'দুর্নীতির 'লালসালু' দিয়ে আবদ্ধ করে রেখেছে সবাইকে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।