ঢাকা, ৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৮ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

প্রথম পাতা

সরজমিন

ডেঙ্গুর চাপ বাড়ছে, বাইরের রোগীই বেশি

আফজাল হোসেন ও মোহাম্মদ রায়হান
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের শয্যায় মায়ের পাশে বসে আছেন কলেজপড়ুয়া সন্তান সৌরভ। মা জেসমিন বেগম বমি করছেন, আর  সৌরভ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মায়ের সেবা করছেন। সৌরভের চেহারা জুড়ে ক্লান্তির ছাপ। নিজের শারীরিক ক্লান্তি ও  দুর্বলতাকে পাত্তা না দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছেন মায়ের জন্য। মা যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সৌরভ মানবজমিনকে বলেন, আমাদের বাড়ি নরসিংদীর পলাশ উপজেলায়। আমার মা ছয়দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়, কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকার মুগদা মেডিকেলে আনা হয়। মায়ের প্লাটিলেট ১১ হাজারে নেমে গিয়েছিল। এখন একটু উন্নতি হয়ে ২৩ হাজারে এসেছে। কিন্তু এখনো আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। আমি পরিবারের একমাত্র সন্তান। আমার বাবা সৌদি প্রবাসী। ঢাকায় আমাদের দেখাশোনার মতো কেউ নেই। খাবার, গোসল সবকিছুতে কষ্ট হচ্ছে। বাধ্য হয়ে বাইরের খাবার খেতে হচ্ছে। আতঙ্কিত আছি কখন আমি নিজেই ফুড পয়জনিংয়ের শিকার হই। চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসার মান ভালো। চিকিৎসকরা নিয়মিত আসেন, নার্সরাও খুব আন্তরিক।

শুধু সৌরভের মা জেসমিন বেগমই নন, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে। কারণ সারা দেশেই হু হু করে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে ভিড়। কোথাও কোথাও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত শয্যার  চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০৪ জন। এর মধ্যে অর্ধেকই আক্রান্ত বরিশাল বিভাগে। তবে, ঢাকার হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালে অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগীই ছিলেন ঢাকার বাইরের। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা বৃদ্ধি।  

সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডেঙ্গু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, দুইটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওয়ার্ডগুলোতে কোনো শয্যা খালি নাই। ওয়ার্ডের বাইরেও ফ্লোরে শুয়ে কিছু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডেঙ্গু রোগীদের বেশির ভাগের হাতেই স্যালাইন দেয়া। প্রত্যেক রোগীর পাশে স্বজনরা বসে আছেন। ক্লান্ত হয়ে অনেকেই রোগীর পাশে শুয়ে আছেন। রোগী ও স্বজনরা বলছেন, ডেঙ্গু ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৫ জন রোগী আসেন, আবার সমান সংখ্যক রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়েন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিটের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. উচ্ছাস বলেন, ঢাকা মেডিকেলে এখন ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে অনেক রোগী আসছেন। তাদের বেশির ভাগই আগে কোথাও না কোথাও চিকিৎসা নিয়েছেন। ডেঙ্গু রোগীদের সাধারণত খারাপ পরিস্থিতি হলে এখানে আসেন। জ্বর কমার পরে উচ্চ রক্তচাপ কমতে থাকে। তখন  তাদের প্লাটিলেট কমতে থাকে। এখানে চিকিৎসা নিয়ে সাধারণ রোগীরা ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কিডনি বা লিভারে পৌঁছে যায়। তখন মৃত্যুঝুঁকিও থাকে।  

কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে ঢাকা মেডিকেলে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাজিদ হোসেন। তার মা আমেনা  বেগম বলেন, পাঁচদিন ধরে কুমিল্লা থেকে এসেছি। কুমিল্লায়ও চিকিৎসা নেয়া যেতো। কিন্তু আমরা আরেকটু ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে এসেছি।  মোহাম্মদ জুলফিকার আলী নামের একজন রোগী বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢামেকে এসে ভর্তি হয়েছি। আমার গত মাসের ২৮ তারিখে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তখনো নারায়ণগঞ্জে ছিলাম। পরিস্থিতি ঠিকঠাক ছিল না। পরে ঢাকা মেডিকেলে ২ তারিখে ভর্তি হই। নারায়ণগঞ্জে আমি যেখানে ছিলাম মশারি ছিল না। তিন তলায় থাকতাম। ভাবতাম মশা নেই। পরে জ্বর ধরা পড়লে মশারি টানানো শুরু করি। এখন কিছুটা ভালো আছি। ডাক্তার বলেছেন- ২/১ দিনের মধ্যে চলে যেতে পারবো। মাহবুব নামের আরেক রোগী ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছেন। তিনি বলেন, আমি আজ ১০ দিন ধরে জ্বরে ভুগছি। বাসায় ঠিকঠাক মশারি টানাতাম না। এরপর হঠাৎই আমার জ্বর শুরু হলো। হাসপাতালে ভর্তি আছি ৬ দিন ধরে। এখন মোটামুটি সুস্থ আছি। 

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের দায়িত্বরত ডা. আসমা আক্তার জানান, হাসপাতালের বর্তমানে হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ৫২ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। মোট শয্যা রয়েছে ৭০টি। বিগত সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। জুলাই ও আগস্টে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে সতর্ক করেন তিনি। ভর্তি হওয়া রোগীদের অধিকাংশই এসেছেন ঢাকার বাইরের এলাকা থেকে। বিশেষ করে কুমিল্লার দাউদকান্দি, বরিশালসহ আশপাশের অঞ্চল থেকে রোগী বেশি আসছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ বলে জানান তিনি। ডা. আসমা আরও জানান, বর্তমানে ডেঙ্গুর পাশাপাশি করোনা ও চিকুনগুনিয়ারও প্রাদুর্ভাব রয়েছে। তাই জ্বর হলে অবহেলা না করে অন্তত দুইদিন পর ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন তিনি। 

প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছেন সবুজবাগ এলাকার বিলকিস আক্তার তার স্বামী শাহ আলম তাকে ডাবের পানি খাওয়াচ্ছিলেন। শাহ আলম বলেন, আজকে ৫ দিন ধরে তার জ্বর। প্লাটিলেট ২০ হাজারে নেমে যাওয়ায় ইমারজেন্সি তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করেছি। হাসপাতালের চিকিৎসার মান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানকার চিকিৎসা ভালো নার্স ও ডাক্তার নিয়মিত এসে রোগীর খোঁজখবর নেন। তবে এ হাসপাতালের লিফটে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে; তাই নিচে গেলে উপরে উঠতে ভয় লাগে। ডাক্তার বলেছে- ডাব, পেঁপে খাওয়াতে। তাই এগুলো কিনে নিয়ে এসেছি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে মশকনিধন কীটনাশক সেপ্র করা হচ্ছে না। তাই ঐ এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. বেনজির আহমেদ মানবজমিনকে বলেন- বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিষয়ে বলতে গেলে আমাদের আরও ২০০০ সালে ফিরে যেতে হবে। আমাদের প্রায় ২৫ বছর আগে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এই সময়টাতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার তা নেয়া যায়নি। যার ফলে ডেঙ্গু বাড়ছে। তাই এডিস মশা এবং ডেঙ্গু ভাইরাস সারা দেশে ছড়িয়ে  গেছে। আগে ডেঙ্গু হতো ঢাকা, চট্টগ্রাম বা মেট্রোপলিটন জেলাগুলোতে। ঢাকায় ২০২০ সাল ছাড়া বড় আকারের ডেঙ্গু হয়নি। কিন্তু এখন ঢাকার বাইরেও সমানভাবে ছড়িয়ে গেছে। বরগুনার মতো একটি ছোট শহরে সমানে রোগী বাড়ছে এবং সমানে মৃত্যু হচ্ছে। কারণ ঢাকায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যে সক্ষমতা তা অন্য কোনো মফস্বলের জেলায়  নেই। ঢাকায় সক্ষমতা থাকার পরও ঢাকায় যদি এমন হয়, অন্য যে সকল জেলায় সক্ষমতা নেই সেখানে কী অবস্থা হবে? বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হয় ঢাকায়। এখানে নানা ধরনের জিনিসপত্র সহজেই দেয়া যায়। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে মাত্র একজন সিনিয়র কন্সালটেন্ট থাকেন। অথচ ঢাকায় এত নামিদামি প্রফেসর ডাক্তার আছেন, তবুও এখানে রোগী বাড়ছে, তাহলে অন্য জেলায় তো নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব। মফস্বলের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাও ঠিকমতো হয় না। পর্যাপ্ত আইসিউ লাগে, সেসব নেই। ঢাকায় রোগী নিয়ে আসতে আসতে অনেকেই মারা যান। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ  সম্ভব নয়। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, ২০১৮ সালে ডেঙ্গু যখন মহামারি আকার ধারণ করে তখন এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গু রোধ করার জন্য এডিস মশা নির্মূল করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে সারা দেশে একযোগে দুইদিন অভিযান চালিয়ে এডিস মশার প্রজননস্থানগুলো ধ্বংস করতে হবে। তাছাড়া, যেসকল স্থান ডেঙ্গুর হটস্পট সেসব স্থান চিহ্নিত করে সেখানে বাড়তি ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাছাড়া, সমপ্রতি জাপান ডেঙ্গুর জন্য একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে। যা তরুণদের ব্যবহার করার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করেছে সেটি দেশে আনা যেতে পারে।  

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status