প্রথম পাতা
ইভিএম কেনাকাটায় অনিয়ম
ইসি’র শতাধিক কর্মকর্তা দুদকের নজরে
মারুফ কিবরিয়া
৪ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
মানহীন ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের অভিযোগে একটি অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান এই অনুসন্ধানে নির্বাচন কমিশনের সাবেক ও বর্তমান অনেক কর্মকর্তা এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। দুদক সূত্র বলছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মানহীন ইভিএম ক্রয় করে অতি উৎসাহ দেখিয়েছেন ইসি কর্মকর্তারা। বিশেষ করে এই প্রকল্প থেকে বড় ধরনের লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে কিনা সে বিষয়েও চলছে অনুসন্ধান।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, নিম্নমানের ইভিএম মেশিন ক্রয়ের সঙ্গে জড়িত অন্তত শতাধিক ইসি কর্মকর্তাকে ঘিরে অনুসন্ধান করছে দুদক। এর মধ্যে সাবেক প্রকল্প পরিচালক, সাবেক সিইসি কেএম নূরুল হুদা, সাবেক একাধিক ইসি সচিবসহ ইসি’র সাবেক বর্তমান কর্মকর্তারা রয়েছেন। এ ছাড়া একটি বিশেষ বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও অনিয়ম রয়েছে কিনা তা খোঁজা হচ্ছে দুদকের অনুসন্ধানে। অন্যদিকে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থছাড় না পাওয়া প্রকল্পের ছক কষা ইসি কর্মকর্তাদেরও দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় আনা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।
সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে চেয়েছিল ইসি। সে সময় সংস্থাটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। ওই নির্বাচনে দেড়শ’ আসনে ইভিএম ব্যবহারের লক্ষ্যে মেশিন কেনার জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়। কিন্তু তৎকালীন সরকার শেষ পর্যন্ত সেই অর্থছাড় দেয়নি। কিন্তু ইসি’র বেশকিছু উৎসাহী কর্মকর্তা ইভিএম প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে ছিলেন। দুদক বলছে, উৎসাহ দেখানো কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। যদি ওই প্রকল্পটির জন্য অর্থছাড় হতো তাহলে আবারও রাষ্ট্রে নয় হাজার কোটি টাকা নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থেকে যেত।
সূত্র বলছে, বছর সাতেক আগে নির্বাচন কমিশনের কেনা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মান ঠিকঠাক ছিল কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করছে দুদক। তৎকালীন নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালে এক লাখ ৫০ হাজার ইভিএম কেনে। এর মধ্য এক লাখ ৫০০ মেশিন ব্যবহারের অনুপযোগী বলে অভিযোগ রয়েছে। ৬১৮টি ইভিএম রয়েছে ইসিতে। প্রায় ৮৬ হাজার রয়েছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ)। ১০ আঞ্চলিক কার্যালয়ে রয়েছে প্রায় ৬২ হাজার ইভিএম। গত জানুয়ারিতে দুদকের এক অভিযানে ১ হাজার ৫৯৯টি মেশিনের কোনো হদিস না পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন।
সে সময় তিনি বলেছিলেন, মেশিনগুলো ‘অযত্ন-অবহেলায়’ পড়ে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে থাকা ৬১৮টি মেশিনের মধ্যে দৈব চয়নের ভিত্তিতে কয়েকটি মেশিনের ‘অপারেশনাল ক্যাপাসিটি’- যাচাই করে ত্রুটি দেখা গেছে, যা ‘নিম্নমানের মেশিন কেনার’ ইঙ্গিত দেয়। দুদক টিমের সঙ্গে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরাও মেশিনগুলো ‘মানসম্মত নয়’- বলে মত দেন। এক যুগ আগে বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহারের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। আওয়ামী লীগ সরকার ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে থাকলেও তার ঘোর বিরোধী ছিল বিএনপি। দলটির নেতাদের ভাষ্য ছিল, যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণে ব্যাপক কারচুপির সুযোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হলেও ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়া কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ওই বছরের মে মাসে অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এ কায়কোবাদসহ একদল প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞকে ইভিএম দেখিয়ে ভোটগ্রহণে তা ব্যবহারের সম্মতি নেয় ইসি।
ইভিএম’র কার্যক্রম দেখে ইসি’র সঙ্গে ২০২২ সালের ২৫শে মে মতবিনিময়ের পর ভোটে যন্ত্রগুলো ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন জাফর ইকবাল ও কায়কোবাদ। জাফর ইকবাল সেদিন বলেছিলেন, ইভিএম নিয়ে ডেমনস্ট্রেশন পুরোটাই দেখেছি। তার ভেতরের খুঁটিনাটি, টেকনিক্যাল বিষয় যা আছে, তাও জেনে নিয়েছি। সবশেষ আমাদের জন্য রাখা মেশিনটি খুলে দেখেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কনভিন্সড হয়েছি। অত্যন্ত চমৎকার মেশিন। ইভিএম’র বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলকেও যন্ত্রটি ব্যবহারের পক্ষে সায় দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি। আর বুয়েটের শিক্ষক কায়কোবাদ ইভিএম’র প্রতি আস্থা রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, এর প্রতিটি অংশ এমনভাবে কাস্টমাইজড, একজন ইচ্ছা করলে সেখানে পরিবর্তন করতে পারবে না। কোনো মেশিনকে শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না। তবে এখানে যেটা করা হয়েছে মেশিন লেভেলে আর কোনো কাজ নেই, আর ম্যানিপুলেশনের কোনো সুযোগ নেই।
তাদের ওই মতের ওপর আস্থা রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান- তখনকার সিইসি হাবিবুল আউয়াল। সেই কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত দেড়শ’ আসনে ইভিএম-এ ভোট করার পরিকল্পনা করে। তবে দুই লাখ নতুন ইভিএম কেনার প্রস্তাবে সরকার সায় না দেয়ায় ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। ইভিএম সংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে দুদকের তিন সদস্যের একটি দল, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত। অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে নথিপত্র তলব করে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও পাঠিয়েছেন তিনি।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনুসন্ধান শুরুর পর থেকে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিসহ বেশক’টি প্রতিষ্ঠানে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যেই সাবেক সিইসি কেএম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে দুদকের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া সাবেক ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবির খোন্দকার ও সাবেক ইসি সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমকে তলব করা হতে পারে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরসহ তৎকালীন দায়িত্বে থাকা ইসিদের তলব করার পরিকল্পনা রয়েছে দুদকের।
অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ইভিএম’র কেনাকাটায় অনিয়ম সংক্রান্ত অনুসন্ধান চলমান। কর্মকর্তা আইন ও বিধি মেনেই কাজ করছেন। এ বিষয়ে কমিশনকে যথাসময়ে তিনি প্রতিবেদন পেশ করবেন। তারপরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।