প্রথম পাতা
মব সন্ত্রাস চলছেই, নিষ্ক্রিয় প্রশাসন
এই মৃত্যুর দায় কার?
স্টাফ রিপোর্টার
৪ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
কুমিল্লার মুরাদনগরে গণপিটুনিতে একই পরিবারের ৩ জন নিহত -নিজস্ব ছবি
৫ই আগস্ট সরকার পতনের দিন থেকেই ঘটছে একের পর এক মবের ঘটনা। শুরুতে পরিস্থিতি ছিল টালমাটাল। তিনদিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্দেশে গণহত্যায় অংশ নেয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই ছিল অসহায়। জটিল এক পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নেয়ায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সক্রিয় হতে শুরু করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে মব বন্ধের আহ্বান জানায়। সময়ে সময়ে দেয়া হয় হুঁশিয়ারি। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় এক বছর পরও ঘটছে মবে ঘটনা। হচ্ছে প্রাণহানি। বাড়ি-ঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। হামলা হচ্ছে থানায়। পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব ঘটনা থামাতে পারছে না স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মব সহিংসতায় অন্তত ১৭৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে বহু মানুষ। এই পরিসংখ্যান প্রকাশের পর গতকাল কুমিল্লার মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে জুনে এমন আরও কয়েক জায়গায় পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এমন সব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এভাবে প্রকাশ্যে সংঘদ্ধভাবে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায়, মৃত্যুর ঘটনায় দায় কার এই প্রশ্ন সামনে এসেছে। মব তৈরি করে মানুষ হত্যা বা নির্যাতনের ঘটনাগুলোর জন্য মামলা এবং যথাযথ বিচারিক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বলেও মনে করছেন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা।
কুমিল্লায় একই পরিবারের ৩ জনকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগর (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, মুরাদনগর একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার আকুবপুর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ডের কড়াইবাড়ি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- রুবি বেগম (৫৮), তার ছেলে রাসেল (৩৫), মেয়ে জোনাকি আক্তার (২৭)। রবি বেগমের আরেক মেয়ে রুমা আক্তার গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন। ঘটনার পর এলাকাজুড়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, নিহত পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় মাদক ব্যবসা ও অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত ছিল। এসব কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এলাকায় তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পক্ষের বিরোধ চলছিল। পূর্ব-বিরোধের জের ধরেই এই বর্বর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে, নিহত রাসেলের স্ত্রী মোসাম্মৎ মীম দাবি করেন, সমপ্রতি মোবাইল চুরির ঘটনা নিয়ে বিরোধের জেরেই তাদের পরিবারের চারজনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। বুধবার বিকালে রুবির মেয়ের জামাই মনির হোসেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিনের একটি মোবাইল ছিনতাই করেন। এ ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া এবং আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল রুবিকে জিজ্ঞাসা করতে গেলে তাদের ওপর হামলা করা হয়। এতে এলাকায় চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল এবং ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। খবর পেয়ে এলাকার শতাধিক লোক ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের গণপিটুনি দেয়।
এ বিষয়ে আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল বলেন, মোবাইল ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা আমি জিজ্ঞেস করতে গেলে আমাকে এবং ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়াকে মারধর করা হয়। আমরা সম্মান বাঁচাতে ঘটনা এড়িয়ে এলাকায় চলে যাই। পরে গ্রামবাসীর সঙ্গে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে গণপিটুনিতে মাদক ব্যবসায়ী রুবি, তার ছেলে এবং এক মেয়ে নিহত হয়। আসলে এমন হত্যাকাণ্ড কোনো ভাবেই কাম্য নয়।
এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহম্মদ খান। এ সময় তিনি জানান, আইন হাতে তুলে নিয়ে যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতিমধ্যে অভিযুক্তদের শনাক্তে অভিযান শুরু হয়েছে। বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান জানান, পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষের একটি সন্ত্রাসী দল বৃহস্পতিবার সকালে রুবি বেগমের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালায়। প্রথমে তাদের লাঠিসোটা দিয়ে পেটানো হয়। পরে তাদেরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। ঘটনাস্থলেই রুবি, রাসেল ও জোনাকির মৃত্যু হয়। এরপর স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় রুমা আক্তারকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, লালমনিরহাট পাটগ্রামে থানায় হামলা চালিয়ে সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় ওসিসহ আহত হয়েছেন ৩০ জন। এ সময় ওসির রুমসহ থানার ৪টি কক্ষ ভাঙচুর, ল্যাপটপ, সরকারি জিনিসপত্র লুটের ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে বিজিবি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বিএনপি’র সাবেক নেতা চপল হোসেনকে প্রধান আসামি করে ৩২ জনের নামে পাটগ্রাম থানায় মামলা করেছে। এ ছাড়াও আরও কয়েক হাজার অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
সরজমিন পাটগ্রাম থানায় গিয়ে দেখা যায় লণ্ডভণ্ড জিনিসপত্র। সব জায়গায় ভাঙচুরের চিহ্ন। থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ইজারা দেয়া হয় বালুমহাল। ইজারা নির্ধারিত স্থানে বালু না তুলে ইজারাদার কলেজ রোডে মহাসড়কে বালুর ট্রাক প্রতি ২ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করে। বাধা দিলেও ইজারাদার না মেনে চালিয়ে যায় চাঁদা আদায়। বুধবার বিকালে দুইজনকে চাঁদা তোলার সময় পুলিশ আটক করে। আটককৃত দুইজনকে পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এতে ইজারাদারসহ তার লোকজন বুধবার রাত ১১টায় পুলিশ ওই দুই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে থানায় নেয়ার পথে হামলা করে। তারা থানার ওসির একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। ছিনিয়ে নেয় ওই দুই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে। পরে থানায় হামলা চালিয়ে ওসির কক্ষসহ ৪টি কক্ষ জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। লুটপাট করে নিয়ে যায় সরকারি ল্যাপটপ, কাগজপত্রসহ মূল্যবান জিনিস। হামলাকারীদের বাধা দিলে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশকে মারপিট করে। হামলাকারীরা এইচ.এস.সি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রুমে হামলা চালাতে যাওয়ার চেষ্টার সময় পুলিশ টিয়ারসেল, রাবার বুলেট ছুড়ে। হামলাকারীর সংখ্যা বাড়লে আত্মরক্ষায় পুলিশ সদস্যরা থানা ছেড়ে চলে যান। পরে কয়েক প্লাটুন বিজিবি সদস্য এসে পাটগ্রাম থানা ভবন ঘিরে রাখেন। এ সময় ভয়ে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা। ওদিকে এই হামলার ঘটনার সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন পাটগ্রাম পৌর বিএনপি’র সভাপতি মোস্তফা সালাউজ্জামান ওপেল।
তিনি জানান, ওসি মিজানুর সঙ্গে বালু কোয়ারিদের হামলা এর সঙ্গে বিএনপি জড়িত না। ওদিকে এ ঘটনার পর বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থলে ছুটে যান রংপুর পুলিশের ডিআইজি মো. আমিনুর রহমান। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেন। ওদিকে জেলা প্রশাসক এইচ.এম রকিব হায়দার বলেন, বালুমহালের ঠিকাদাররা নির্ধারিত স্থানে বালু না তুলে তারা মহাসড়কে চাঁদাবাজি শুরু করে অন্যায় করে। অপর দিকে বালুমহাল ইজারাদার চঞ্চল ও চপল হোসেন জানান, পাটগ্রাম থানার ওসি বালু কোয়ারিদের নিকট টাকা দাবি করে টাকা না দেয়ায় সে মিথ্যা নাটক সাজানোর কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য পুলিশ দায়ী। পাটগ্রাম থানায় অতিরিক্ত আর্মড পুলিশসহ অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। পাটগ্রাম থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক না। থানায় হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের সিসি ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তার করা হবে।
আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ওসিদের বরখাস্তের দাবি এনসিপির:
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, আওয়ামী লীগের আমলে বিভিন্ন থানায় নিয়োগপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) বরখাস্তের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। একইসঙ্গে তারা ৪ দফা দাবি পেশ করেন। গতকাল চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহরে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করা হয়। পটিয়া থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সামপ্রতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় পুলিশের সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতা খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, পুলিশ বাহিনীতে দৃশ্যমান সংস্কার প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ আমলে থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সবাইকে বরখাস্ত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে এনসিপি’র যুগ্ম মুখ্য সংগঠক জুবাইর হাসান চার দফা দাবি জানিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা দেন। দাবিগুলো হলো- পটিয়া থানা থেকে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুরকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও বিচার এবং নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারকে (এসপি) অপসারণ করা, পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের নির্দেশনা দেয়া এবং এখন থেকে যেকোনো থানায় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের চিহ্নিত কাউকে নেয়া হলে কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) টানা চাপ ও ৯ ঘণ্টার সড়ক অবরোধের পর বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পটিয়ার ওসিকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। তার স্থলে চন্দনাইশ থানার ওসি (তদন্ত) যুযুৎ যশ চাকমাকে পটিয়ার ওসি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।