ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

নিমতলী ট্র্যাজেডি’র ১২ বছরেও নেয়া হয়নি ব্যবস্থা

নাইম হাসান
১৯ আগস্ট ২০২২, শুক্রবার
mzamin

সড়কের দুই পাশে সারি সারি বহুতল ভবন। নিচতলায় কেমিক্যাল সামগ্রীর দোকান-গোডাউন। তার উপরে মানুষের বসবাস। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কেমিক্যালের গন্ধ  এসব ভবনের পাশেই রয়েছে মসজিদ ও গির্জা। এটি ঢাকার আরমানিটোলার একটি গলির দৃশ্য। ভয়াবহ নিতমলী ট্র্যাজেডির এক যুগ পেরোলেও বদলায়নি পুরান ঢাকার এই দৃশ্য। নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পরে নিরাপদ নগরী গড়ে তুলতে সিটি করপোরেশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেও ব্যবসায়ীরা না মানায় তা আর সম্ভব হয়নি। চকবাজার অগ্নিকাণ্ডে ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক মো. হাসান ও সোহেলসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা হয়। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করলেও পরে তারা জামিনে মুক্তি পান। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরান ঢাকার কেমিক্যালের দোকানে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইলসহ ভয়ঙ্কর কেমিক্যাল দাহ্য পদার্থ বিক্রি হয়।

বিজ্ঞাপন
এসব কেমিক্যালে সামান্য আগুনের স্পর্শ পেলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। হয়ে যেতে পারে চকবাজারের চুড়িহাট্টা বা নিমতলীর মতো ট্র্যাজেডি।  স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এখাকার বাতাসে শুধু কেমিক্যালের গন্ধ। আমরা ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। আশপাশে অনেক পরিবারের বসবাস। কখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে এই ভেবে সবসময় চিন্তিত থাকি। বিশেজ্ঞরা বলছেন, জনবসতির জায়গায় যেকোনো রাসায়নিকের গুদাম থাকা বিপজ্জনক। 

যে কোনো সময় প্রাণহানি ঘটতে পারে। এছাড়াও শ্বাসতন্ত্রীয় রোগ যেমন- শ্বাসের টান, হাঁচি-কাশি, হাঁপানি বাড়িয়ে দিতে পারে। এসব জায়গা থেকে রাসায়নিক সরানোর কথা থাকলেও সরকারি ঢিলেমির জন্য সঠিক সময়ে হচ্ছে না বলে জানা যায়।  ১২ বছর ধরে স্ত্রীসহ দুই স্কুল পড়ুয়া সন্তান নিয়ে আরমানিটোলায় ভাড়া থাকেন সালাহউদ্দীন। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় অনেক বেশি শঙ্কিত তিনি। বলেন, গত বছরে পাশের ভবনেই আগুন লেগেছিল। তারপর থেকে আমরা সবাই ভয়ে থাকি। বাসার উপরে থাকি। নিচেই সব কেমিক্যালের দোকান। ঘটনা ঘটার আগে তো কেউ স্বীকার করে না কার কাছে কি ধরনের কেমিক্যাল আছে। ঘটার পরে আসল কাহিনী জানা যায়। এসব রাসায়নিকের দোকানগুলো এখান থেকে সরে গেলে আমরা উপকৃত হবো। স্থানীয় গ্লাস ব্যবসায়ী ওয়াসিম উদ্দীন বলেন, এখাকার বাতাসে শুধু কেমিক্যালের গন্ধ। আমরা ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। এভাবে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যাই। আশপাশে অনেক বসতি আছে। সবসময় চিন্তিত থাকি। কখন যে কি হয়ে যায়। সেদিন আমাদের মার্কেটে কি যেন একটা ব্লাস্ট হয়েছিল। কিসের একটা গন্ধ তখন পুরো মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। ওইদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম। দাহ্য কেমিক্যালগুলো দ্রুত অন্যত্র না সরালে আমাদের যে কি হবে আল্লাহ্‌তায়ালা জানেন। আরমানিটোলার স্থানীয় কেমিক্যাল ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কেরানীগঞ্জ দোহারের রোডে সরকার আমাদের একটা জায়গা দিয়েছে। সেখানে এখনো কিছু হয়নি। খালি জায়গা পড়ে আছে। অনেকে নিজেদের উদ্যোগে কেরানীগঞ্জে গোডাউন নিয়ে গেছে। সেখানে নিলেও ব্যবসা করার জন্য পরিবেশ থাকতে হবে। ব্যাংক ও ভালো রাস্তা হতে হবে। যোগাযোগের জন্য সঠিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

গত বছর ২৩শে এপ্রিল আরমানিটোলায় পুড়ে যায় হাজী মুসা ম্যানশন। এই ঘটনায় প্রাণ হারায় ৪ জন। পরে সরকার বাড়িটি সিলগালা করে দেয়। ওই ভবনে গোডাউন ছিল আরিফের। ১৪ বছর ধরে তিনি সেখানে কেমিক্যালের ব্যবসা করতেন।  এই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা কেউ কেউ বলছেন দাহ্য পদার্থ রাখবে না এমন অঙ্গীকার করে তারা বাসা ভাড়া দেন। নূরজাহান প্লাজায় ২৫টি কেমিক্যালের দোকান ও ১০টি গোডাউন রয়েছে দীপ আখন্দের। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আগে আমাদের ভবনে দাহ্য জাতীয় কেমিক্যাল ছিল। মুসা ভবনের আগুনের ঘটনার পরে আমরা তাদের রাখিনি। কোনো দাহ্য পদার্থ যেন না রাখতে পারে এটা নিশ্চিত করেই আমরা এখন ভাড়া দেই। মাঝে শুনেছিলাম এখান থেকে গুদামগুলো সরিয়ে নিয়ে যাবে। পরে তেমন কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি।  পুরান ঢাকা থেকে অন্যত্র এই দোকানগুলো স্থাপন করার কথা থাকলেও এতোদিনে তা কেন হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন বলেন, সরকার আমাদের জন্য মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানায় কেমিক্যাল পল্লী করছে। এর কাজ চলমান। ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা আছে। শেষ হলে এখানে শুধু অফিস থাকবে। গোডাউনগুলো ওইদিকে চলে যাবে। সব কেমিক্যালে তো আগুন লাগে না। যারা দাহ্য কেমিক্যাল তৈরি করে তারা ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় গোডাউন নিয়ে অনুমোদন নিয়েছে। 

এখানে শুধু কিছু স্যাম্পল আছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে মার্কেট তদারকি করি।  বিস্ফোরক পরিদপ্তরের উপ-প্রধান পরিদর্শক ড. মো. আব্দুল হান্নান মানবজমিনকে বলেন, কেউ চুরি করে দোকান দিতেই পারে। বিস্ফোরক পরিদপ্তর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কোনো পণ্য পুরান ঢাকায় রয়েছে বলে আমাদের তথ্য নেই। সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এর সমন্বয় করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, জনগঠিত বসতিতে যেকোনো রাসায়নিকের গুদাম থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক। যেকোনো সময় আগুন লাগতে পারে। অথবা লিকেজ হয়ে বাতাস, মাটি ও পানিকে দূষিত করতে পারে। এটি এতো বিপজ্জনক যে, কোনো সময় জীবনহানির কারণ হতে পারে। নিমতলা, চুড়িহাট্টা ও সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে এটি আমরা দেখেছি। কেমিক্যালগুলো স্টোর করার ক্ষেত্রে ভিন্ন কেমিক্যালের জন্য ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিয়ম না মেনে স্টোর করা হলে রাসায়নিকের গন্ধ ছড়ায়। চুইয়ে পড়া গ্যাস ড্রেন থেকে নদীতে যায়। পরে এটি আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে। কতগুলো কেমিক্যাল আছে বিষাক্ত গ্যাস যা আমাদের শ্বাসতন্ত্রে ক্ষতি করে। শ্বাসতন্ত্রীয় রোগ যেমন- শ্বাসের টান, হাঁচি, কাশি, হাঁপানি বাড়িয়ে দেয়। সকল রাসায়নিক পদার্থ গুদামজাত করার জন্য জনগোষ্ঠী থেকে দূরে নিরাপদ পরিবেশে আলাদা ডিপো বা স্টোরেজ হাউজ করা দরকার। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, আমরা চাই অনতিবিলম্বে এই কেমিক্যালগুলো চলে যাক। শিল্প মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

 তারা ভালো বলতে পারবে। আমরা ৩ বছর ধরে লাইসেন্স দেয়া ও নবায়ন করা বন্ধ রেখেছি। কবে এসব রাসায়নিক দোকানগুলো সরানো হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ তাই মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ সরাসরি তদারকি করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে প্রধান করে একটি বিশেষ কমিটি করে দেয়া হয়েছে। সেখানে মন্ত্রীপরিষদ সচিব, প্রাণিসচিব, শিল্প সচিব, বিষ্ফোরক পরিদপ্তরসহ আমরাও আছি। আমাদের কাছে যেসব সহযোগিতা চেয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে সকল সহযোগিতা আমরা করেছি। গত ২২শে মে তারা সভাও করেছেন। পুরান ঢাকায় কয়টি রাসায়নিকের দোকান রয়েছে এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে রয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে কমিটি করা হয়েছিল। আমাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা সেখানে ছিলেন। আমরা উনিশ শ’ ২৪ জনের তালিকা তৈরি করে দুই বছর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছি। তারা অস্থায়ী ও স্থায়ী প্রতিস্থাপনের জন্য কাজ করছে। গত কয়েক বছরে কেমিক্যাল বিস্ফোরিত হয়ে পুরান ঢাকায় বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। ২০১০ সালে কেমিক্যাল বিস্ফোরণ হয়ে নিমতলীতে ১২৪ জনের নির্মম মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এটিও ছিল কেমিক্যাল থেকে। আগুন ছড়িয়ে নিমেষে চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ।

 ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা অবৈধ কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এই আগুনে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেটকার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেল সহ শতাধিক যানবাহন পুড়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যানজটে আটকে থেকে প্রাণ হারান অর্ধশতাধিক মানুষ। নিমিষে চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ। আগুন লাগার ১৪ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘটনাস্থলেই লাশ হন ৬৭ জন। পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে। ২০২১ সালের ২৩শে এপ্রিল ভোররাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা হাজী মুসা ম্যানশনে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে। ভবনের নিচতলায় আগুন লাগলে তার ধোঁয়ায় ভবনের দুই তলা থেকে ছয় তলার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বারান্দার গ্রিল কেটে সবাইকে ফ্লোরের লোকজনকে উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে আনেন। এই ঘটনায় ৫ জন প্রাণ হারান।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status