প্রথম পাতা
অভ্যুত্থানকে বাজার দরে বিক্রি করা হয়েছে
স্টাফ রিপোর্টার
২৯ জুন ২০২৫, রবিবার
উমামা ফাতেমা। জুলাই আন্দোলনের সম্মুখসারির নেতা। গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে দক্ষ নেতৃত্বে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এ অন্যতম সমন্বয়ক। অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর প্ল্যাটফরমটির মুখপাত্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। অভ্যুত্থানের নেতারা যখন রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইছিলেন, তখন থেকে তার সঙ্গে দূরত্ব। রাজনৈতিক স্বার্থে প্ল্যাটফরমকে ব্যবহার করতে চাওয়ার ঘোরবিরোধী থাকায় কোণঠাসা করে রাখা হয় তাকে। দীর্ঘদিন চুপ থাকার পর অবশেষে অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গুটিয়ে নিলেন উমামা। এ জুলাইকন্যার দাবি- অভ্যুত্থানকে বাজারদরে বিক্রি করা হয়েছে। ভাই-ব্রাদার কোরাম করে রাখা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে। হেয়ার রোডের মন্ত্রিপাড়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সবকিছু। সুবিধাবাদীরা পোকার মতো খেয়ে ফেলেছে প্ল্যাটফরমটিকে। সংগঠনের ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উমামা ফাতেমার। গতকাল ভোরে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন জুলাইয়ের এ সাহসী কন্যা। যেখানে তিনি লেখেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়েছে গত পরশু। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখানেই শেষ হলো। এনসিপি নামক রাজনৈতিক দলটি গঠনের পর আমি জুলাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো করার দায়বদ্ধতা থেকে এই ব্যানার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু দলীয় লেজুড় ও প্রেসক্রিপশনের বাইরে এই ব্যানারটি স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তো। তাই আমার ওপর অনলাইন, অফলাইনে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করা হয়; যাতে আমি এই ব্যানার নিয়ে কাজ না করি। আমি পুরা বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই একটা গুডউইল থেকে ব্যানারকে সচল করার চেষ্টা করেছিলাম। পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই। যে মানুষগুলার সঙ্গে আমি পাশে দাঁড়ায়ে মিটিং করছি, মিছিল করছি- তারাই পরিকল্পিতভাবে জুনিয়রদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে স্মিয়ার ক্যাম্পেইন চালায়। মানুষ বাইরে যত ভালো সাজার চেষ্টা করুক, ভেতর থেকে কতোটা ছোটলোক হতে পারে- আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই ওই সময়গুলাতে। এই সো কলড সহযোদ্ধারা মানুষকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করে, প্রয়োজন শেষ হলে ছুঁড়ে ফেলতে এক মুহূর্তও লাগে না। আমি মার্চ-এপ্রিল মাসে এই প্ল্যাটফরম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি পোকার মতো ভেতর থেকে প্ল্যাটফরমকে সুবিধাবাদীরা খেয়ে ফেলেছে। হ্যাঁ, আমি বলবো বিভিন্ন শাখা কমিটিতে অনেক গুডউইলের মানুষ ছিল, যারা পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে কমিটিতে আসছিল। চেষ্টা করছে কাজ করার। কিন্তু তারাও এই সুবিধাবাদীদের কাছে জায়গা করতে পারেনি। আমার সঙ্গে অনেকের কথা হয় এখনো। ব্যক্তিগত জায়গা থেকে চেষ্টা করি সাজেশন দেয়ার, হেল্প করার। জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় ইভেন্ট দেখার পর চোখের সামনে সবকিছু ভেঙে পড়তে দেখাটা অনেক অনেক কঠিন। পরবর্তীতে আমার বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করে এই ব্যানার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ব্যানার থেকে সরাসরি পদত্যাগ না করলেও এই ব্যানারের সঙ্গে কার্যত সম্পর্ক ছিন্ন করি গত এপ্রিল-মে মাসে। প্ল্যাটফরম থেকে এম্পাওয়ারিং আওয়ার ফাইটারস নিয়ে কাজে মনোযোগ দিই। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল, সেসবে মনোযোগ দিই। অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পদত্যাগ করবো। একটা পদত্যাগপত্র লিখে আর জমা দিইনি। পারি নাই আসলে। রাজনৈতিকভাবে ভাবলে পদত্যাগ করে আসাটা সব থেকে সহজ। কিন্তু আমি তো মানুষ, অনেক কঠিন, অভ্যুত্থানের কারণে পারি নাই। আমি এই প্ল্যাটফরমে তো দেশ সংস্কার করতে আসছিলাম। কাদা ছোড়াছুড়ি করতে তো আসি নাই এখানে।
উমামা বলেন, জেলা, উপজেলার অনিয়মের খবর আসতো শুধু, সাংবাদিকদের কল আসতো। আমি পরিষ্কার করে বলেছি যারা এই কমিটিগুলো দিয়েছে তাদের আপনারা কেন জিজ্ঞেস করেন না? যাদের সাইনে কমিটি হচ্ছে তাদের মুখের সামনে মাইক ধরেন না কেন?! এই কমিটিগুলো করার সময় আমার কাছে কমপ্লেইন আসলে তো সরাসরি আমি অবজেকশনগুলো জানিয়েছি সাবেক আহ্বায়ক, সদস্য সচিবের কাছে। এনসিপি গঠনের আগে ঢালাওভাবে কমিটি ফর্ম হয়েছে। আমিসহ কয়েকজন এসব কমিটি নিয়ে অবজেকশন দিই। কোনো উত্তর আমাদের দেয়া হয়নি। মুখপাত্র হিসেবে বৈষম্যবিরোধীর পেজের এক্সেস থাকার কথা আমার কাছে, আমার দায়িত্ব হওয়ার কথা মিডিয়া হ্যান্ডলিং। পেইজের এক্সেস দেয়া তো দূরের কথা, এই পেজ থেকে মার্চ মাসে আমার বিরুদ্ধে পর্যন্ত পোস্ট হয়েছে। আমি ব্যবস্থা নিতে চাইলে পেজকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় আর নাইলে ঝরষবহঃ ঃৎবধঃসবহঃ সহ্য করতে হয়। দিনের পর দিন হেন কোনো নোংরামি নাই যা এরা করেনি। জুলাইয়ের পরে এই পরিস্থিতিগুলো ডিল করতে গিয়ে মার্চ, এপ্রিল মাসে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাই। যাদের সঙ্গে কাজ করতে চাচ্ছিলাম তারাও হেয়াররোডের আশায় তাকিয়ে থাকতো। একদিকে আমার কথার সঙ্গে তাল মেলাতো, অন্যদিকে রাতের বেলা হেয়ার রোডে গিয়ে পদ-পদবী নিয়ে বার্গেইনিং করতো, সব খবর আমি পেতাম। আমি কনফ্রন্ট করলে আমাকেও বলা হতো যাতে সুপ্রিম অথরিটির সঙ্গে আমি পদ নিয়ে কথা বলে আসি। আমি সরাসরি বলি যে, আমি কেন ওদের কাছে পদ খুঁজতে যাবো? ওরা আমাকে পদ দেয়ার কে? ও কোন হনু হয়ে গেছে যে আমাকে এসে তারা পদ দেবে? ওর কাছে গিয়ে পদ আনতে হলে প্ল্যাটফরম নিয়ে কাজ করার আর মানে কি?! এসবের ভাই-ব্রাদার রাজনীতির যন্ত্রণায় বদ্ধ জলাশয়ের মতো প্ল্যাটফরম আটকে ছিল। আমি কাজ করতে চাইলে আমাকে করতে দেবে না। বরং পেছনে কথা ছড়ানো হতো আমি প্ল্যাটফরমের কাউকে কাজ করতে দিচ্ছি না, কাউন্সিল আটকে রেখেছি। নেতারা তাদের জুনিয়রদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা সার্কুলেট করে বিভিন্ন ফোরামে। পরবর্তীতে আমি সিদ্ধান্ত নিই এভাবে হয় না। নির্বাহীর যারা অবশিষ্ট ছিল তাদের জানিয়ে দিই। মুখপাত্র পরিচয়টা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থী পরিচয়টাকে আপন করা শুরু করি। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জানতে পারি আমি নাকি বৈষম্যের কাউন্সিল আটকে রেখেছি। অথচ সবাই জানে কাউন্সিল মন্ত্রিপাড়ায় আটকে আছে। আর আমি এই প্ল্যাটফরমের সঙ্গেই নাই। আমি চুপ করে ছিলাম, সেটা নিয়েও একটা না একটা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছিল। আমার এত ক্ষমতা, আমি কমিটি আটকে রেখেছি। অথচ আমি শাখা কমিটি নিয়ে কোনো অ্যাকশন নিতে পারিনি, ঢালাওভাবে পেজ থেকে পোস্ট হওয়া উপজেলা কমিটিগুলোও আটকাতে পারিনি। অথচ যখন হেয়ার রোড থেকে আহ্বায়ক সিলেক্ট হলো তখন নির্বাচন হতে ২০ দিনও লাগেনি।
কাউন্সিলে ভোট দিতে যাওয়ার বিষয়ে উমামা বলেন, আমি শেষ দিন পর্যন্ত কাউন্সিলে ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। যারা কাজ করতে চায়, তারা বেশির ভাগ এই কাউন্সিলে প্রার্থী হওয়ারই সুযোগ পায়নি। ভোটার খুব লিমিটেড, যার মধ্যে একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন সব। জুনিয়ররা ক্যাম্পাসে এসে আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, যাতে ভোটটা দিতে যাই। স্বাভাবিকভাবেই আমি অপারগ ছিলাম। কিন্তু ভোট শেষ হওয়ার ১ মিনিট আগে আমি ভোটটা দিয়ে আসি। এতটুকুই যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি চেষ্টা করছি এখান থেকে ভালো কিছু হোক। আমি ভেতর থেকে চাচ্ছিলাম এই প্ল্যাটফরমটার অন্তত ভালো কিছু হোক। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যেভাবে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে প্ল্যাটফরমকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে, এখান থেকে ভালো কিছু অসম্ভব। এই নির্বাচনে কিছু প্রার্থী ছিল যাদের কাজ করার সত্যিকার ইচ্ছা ছিল। আমি ওই সাপোর্টটা দেয়ার চেষ্টা করছি। তবে রাতের বেলা ফলাফলের পর দেখলাম নির্বাচনে অংশ না নেয়া একজন এসে মেম্বার হয়ে গেছে কাউন্সিলের। এসব দেখে আমি অত্যন্ত লজ্জিত। সেই একই স্বেচ্ছাচারিতা, স্ট্যান্ডবাজি, ভাই-ব্রাদার কোরামের খেলা। এখন বোধ করি এই প্ল্যাটফরমের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের কথা চিন্তা করে আমি এই প্ল্যাটফরম থেকে সকল ধরনের সমর্থন ও কাউন্সিলে প্রদত্ত ভোট প্রত্যাহার করলাম। আমি অত্যন্ত অশান্তিতে আছি। অভ্যুত্থান যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছে, গোষ্ঠী স্বার্থে এই প্ল্যাটফরম একইভাবে বহু মানুষের স্বপ্ন ও সময় নষ্ট করেছে। আমি অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফরমে গিয়েছিলাম। প্ল্যাটফরমে যাওয়ার আগে আমাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবো। কিন্তু প্ল্যাটফরমের মুখপাত্র হিসেবে যাওয়ার পরই টের পাই সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহ- এসব মুখের বুলিমাত্র। শুধু আমি না, অনেক ছাত্রই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্ল্যাটফরমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সবার সঙ্গে শুধু ছলনা হয়েছে। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমার সঙ্গে নোংরামি করেছে এতগুলা মাস, অভ্যুত্থানকে বাজারদরে কেনাবেচা করেছে তাদের আমি কখনো ক্ষমা করবো না। আমি রুহের ভেতর থেকে বদদোয়া দিচ্ছি এই মুনাফিকদের। রাজনৈতিকভাবে চাইলে অনেক সুবিধা আমি নিতে পারতাম। কিন্তু পারি নাই। আসে নাই ভেতর থেকে। অনেক বেশি মানুষ মারা গেছে আসলে। এতগুলা সন্তান এতিম হইছে, মেয়েরা বিধবা হইছে, বাবা-মা সন্তানহারা হইছে। আমি পারি নাই এসবকে পলিটিক্যালি ক্যাশ করতে। আমি গত ৮-৯ মাসকে ঝেড়ে ফেলে সামনে এগোতে চাই। অনেক ভালো ছেলে-পেলেকে এই প্ল্যাটফরমে আমি দেখেছি, গুডউইল আছে যাদের। আমি পরামর্শ দেবো আপনারা সবাই যাতে পড়ার টেবিলে মনোযোগ দেন, কাজে মনোযোগ দেন। আমিও ভেঙে পড়ছি না, গুছিয়ে আনছি সবকিছু। ফি আমানিল্লাহ্।
পাঠকের মতামত
তা-ও ভালো - বাজার দর পাইছে - বেশী লস হয় নাই
I can understand your emotion, may Allah be with you, may Allah bless you, may Allah make your future bright, aameen