প্রথম পাতা
এনবিআরে অচলাবস্থা
দিনে আড়াই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য ব্যাহত
স্টাফ রিপোর্টার
২৯ জুন ২০২৫, রবিবারজাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণসহ কয়েকটি দাবিতে এনবিআর ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ‘কমপ্লিট শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালন করছে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে বন্ধ রয়েছে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর অফিসের সব ধরনের কার্যক্রমও। এমন পরিস্থিতিতে দেশে প্রতিদিন ২৫০০ থেকে ২৬০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, সৃষ্ট জটিলতার কারণে কিছু কিছু ক্রেতা ইতিমধ্যে রপ্তানি আদেশ বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। পাশাপাশি বন্দরে ব্যবহারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার ব্যয় বাড়ছে। এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে চলমান অচলাবস্থা দ্রুত নিরসনের দাবি জানিয়েছেন তারা। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে এনবিআরের বর্তমান অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন।
আন্দোলনের কারণে চলমান অচলাবস্থায় উদ্বেগ জানিয়ে ব্যবসায়ী নেতা ও বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, সরকার চলমান অচলাবস্থার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার সঠিক গুরুত্ব বুঝছে না। এই মিটিং (আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে) মঙ্গলবার ডাকা হয়েছে কেন, আজই (শনিবার) আলোচনা করে এর সমাধান হতে হবে। এনবিআর কর্মকর্তাদের কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে প্রতিদিন প্রায় ২৫০০ থেকে ২৬০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ আমদানি ও রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, চলমান স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা চাপে আছেন। নতুন করে এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে। এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী, এ থেকে ফিরে আসা উচিত। এদিকে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিভিন্ন দপ্তরের কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চালু থাকায় আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকেরা যথাসময়ে আমদানি করা কাঁচামাল খালাস করতে পারছেন না। ফলে দেশের রপ্তানিতে বর্ধিত লিড টাইম আরও বাড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন কার্যক্রম। সৃষ্ট জটিলতার কারণে কিছু কিছু ক্রেতা ইতিমধ্যে রপ্তানি আদেশ বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। পাশাপাশি বন্দরে ব্যবহারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার ব্যয় বাড়ছে। এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সমাধান করা অতীব জরুরি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় একটি দক্ষ, হয়রানিমুক্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গড়ার লক্ষ্যে এর সার্বিক সংস্কার বা আধুনিকায়নকে সমর্থন করে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের অপসারণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি কোনো সফলতা নিয়ে আসবে বলেও আমরা মনে করি না। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অভ কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, যেকোনো দেশের সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের মিথস্ক্রিয়া (ইন্টারেকশন) অতীব জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে এ বেসরকারি খাতের সংলাপ কিংবা ইন্টারেকশন স্তিমিত। এনবিআর শাটডাউনের কারণে আমদানি-রপ্তানির ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। যুদ্ধ ছাড়া কোনো দেশের কাস্টমস বন্ধ থাকে, এটা আমাদের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, এনবিআরে অনেক সৎ অফিসার আছেন। বর্তমান সংস্কারের ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি বলার অধিকার তাদের আছে। আমরা এনবিআরের সংস্কার চাই। তবে এনবিআরের অফিসারদের ভবিষ্যৎ কী, সে বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। ওদিকে সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সাতটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আন্দোলনকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা নিশ্চিত করা; উত্তম কর তথা রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও প্রণীত নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আলাদাকরণ সংক্রান্ত বিতর্কিত অধ্যাদেশ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা এবং এরপর তা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও দেশের বাস্তবতার আলোকে বাস্তবায়ন; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ ব্যবসা বাণিজ্যের সার্বিক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সব জাতীয় প্রতিষ্ঠানে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রেগুলেটরি ও ফ্যাসিলিটেটিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সামগ্রিক ও সমন্বিত উন্নয়নের লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে আধুনিকায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা; অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে নির্দেশ দেয়া এবং আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে কলমবিরতি ও কমপ্লিট শাটডাউনের মতো কর্মসূচি প্রত্যাহারপূর্বক কোনো রকম পূর্বশর্ত ছাড়া অনতিবিলম্বে কাজে যোগদান করা।
কমপ্লিট শাটডাউন চলবে রোববারও: এদিকে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানকে অপসারণ দাবিতে রোববারেও কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দেশের সকল কর, ভ্যাট ও কাস্টমসের দপ্তরে কর্মসূচি পালিত হবে বলে জানিয়েছেন তারা। এর আগে গতকাল এই কর্মসূচির ফলে দেশের বিভিন্ন বন্দরে আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা গেছে। শুক্রবারের মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ না করায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শনিবার একই কর্মসূচির সঙ্গে ‘মার্চ টু এনবিআর’ দেয় আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফরম-এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। কর্মসূচি শেষে দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শনিবার থেকে ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দপ্তরে লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন যথারীতি চলবে। অর্থাৎ রোববারও তাদের এই কর্মসূচি চলবে। এ ছাড়া, রোববার সারা দেশের ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দপ্তর থেকে এনবিআর অভিমুখে শান্তিপূর্ণ মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিও পালিত হবে বলে পরিষদ জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এনবিআর সংস্কার বিষয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চেয়েছে পরিষদ। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন পরিষদের সভাপতি হাছান মোহাম্মদ তারেক রিকাবদার এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি মির্জা আশিক রানা।
বন্ধ আমদানি-রপ্তানিসহ শুল্ককর কার্যক্রম: এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান কর্মসূচির ফলে দেশের বিভিন্ন বন্দরে আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা গেছে। শুক্রবারের মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ না করায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শনিবার একই কর্মসূচির সঙ্গে মার্চ টু এনবিআর দেয় আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফরম-এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। এর ফলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল, ঢাকা কাস্টমস হাউসসহ দেশের সব কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশনের কার্যক্রম। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী সকাল থেকে বন্ধ ছিল আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত সব ধরনের শুল্কায়ন কার্যক্রম। জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানো কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মীরা কাজে না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য সরবরাহসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করে। কর্মীরা আন্দোলনে থাকায় পণ্যের শুল্কায়ন, বিল অব এন্ট্রি দাখিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে বন্দরে আসা পণ্যের সরবরাহ কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের অপারশনাল কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। পণ্য ডেলিভারিও এখনো হচ্ছে। তবে কাস্টমসের শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে তার প্রভাব পড়বে। গতকাল বেনাপোল কাস্টমস হাউসেও একই চিত্র দেখা গেছে। বন্দর থেকে খালাস হয়নি কোনো পণ্য। ফটকে ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়ে বাইরের কাউকে কাস্টমস কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়নি। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এনবিআরের অনলাইন সার্ভারও। ঢাকা কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা বলেন, এখানেও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ছাড়া সব ধরনের কাজ বন্ধ রয়েছে। আন্দোলনকারী কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা সচল থাকবে, তবে অন্যান্য কার্যক্রমে কেউ অংশ নেবেন না।
পাঠকের মতামত
জনাব সরকার - আপনারা কী এদের হাতে বন্দী?