প্রথম পাতা
নয় মাসে হেফাজতে মৃত্যু ২৫
শুভ্র দেব
২৮ জুন ২০২৫, শনিবার
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে আসামি নিহত হওয়ার ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কুমিল্লা ও কিশোরগঞ্জে গ্রেপ্তারের পর দু’জন আসামি মৃত্যুবরণ করেন। আর গণ-অভ্যুত্থানের পর সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৯ মাসে নিহত হয়েছেন ২৫ জন। হেফাজতে মৃত্যুর এসব ঘটনায় মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যান বলছে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আগস্ট মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে পরের ৯ মাসে ২৫ জন নিহত হয়েছেন। হিসাব মতে, সেপ্টেম্বর মাসে ৫ জন নিহত হন। পরে অক্টোবরে ৩, নভেম্বরে ১, ডিসেম্বরে ৩ জন নিহত হন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫, ফেব্রুয়ারিতে ৪, মার্চে ১, এপ্রিলে ২ ও মে মাসে নিরাপত্তা হেফাজতে ১ জন নিহত হন। আর চলতি জুন মাসে এখন পর্যন্ত ২ জন নিহত হয়েছেন।
আসকের তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে যে ৫ জন নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে চারজন যৌথ বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে গ্রেপ্তারের পর আরেকজন নিহত হন। অক্টোবরে যে তিনজন নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে ২ জন পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন। আর আরেকজন নেভি কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনে নিহত হন। নভেম্বর মাসে নিহত ১ জন যৌথ বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে নিহত হন। ডিসেম্বর মাসে নিহত তিনজনের মধ্যে যৌথ বাহিনীর শারীরিক নির্যাতন ও আরেকজন পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আসকের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিহত ৫ জনের ১ জন কোস্ট গার্ড কর্তৃক ক্রসফায়ার, পুলিশ ও ডিবি কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনে ২ জন ও আরও ২ জন যৌথ বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনে নিহত হন। ফেব্রুয়ারিতে নিহত ৪ জনের মধ্যে ২ জন যৌথ বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে ও ১ জন বিমানবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে এবং পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় হার্ট অ্যাটার্কে আরেকজন নিহত হন। মার্চ মাসে ডিবি’র হাতে শারীরিক নির্যাতনে ১ জন নিহত হয়েছেন। এপ্রিলে নিহত দু’জনের মধ্যে ১ জন র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলি ও পুলিশের কাছে থাকা অবস্থায় আরেকজন আত্মহত্যা করেন। মে মাসে নিহত একজন যৌথ বাহিনী কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনে নিহত হয়েছেন।
গত ১৯শে জুন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার এলাকা থেকে শেখ জুয়েল (৩৫) নামের এক যুবককে মাদকবিরোধী অভিযানে আটক করে পুলিশ। আটক অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের অভিযোগ, তিনি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েই মারা গেছেন। অন্যদিকে, ১৩ই জুন রাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী পৌর এলাকায় পুলিশের অভিযানে ফিরোজা বেগম (৫০) নামের এক নারীকে আটক করা হয়। গণমাধ্যম ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না থাকলেও তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরদিন সকালে থানা হেফাজতেই তার মৃত্যু হয়। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ঘটনাটিকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করলেও এখনো থানা ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করা হয়নি, যা ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে অত্যন্ত জরুরি।
এদিকে, কুমিল্লা ও কিশোরগঞ্জে পৃথক ঘটনায় পুলিশ হেফাজতে দুই নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এ ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে সংগঠনটি অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে। আসক বলছে, উভয় ঘটনার ক্ষেত্রেই নিহতদের পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে। কিন্তু পুলিশ তাদের বক্তব্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে হেফাজতে মৃত্যুকে শুরু থেকেই স্বাভাবিক বলে দাবি করছে যা কোনো তদন্ত ছাড়াই একতরফা ব্যাখ্যা প্রদানের শামিল। সংগঠনটি মনে করে, তদন্ত চলাকালে পুলিশের এ ধরনের অবস্থান গ্রহণ ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায় হতে পারে। আসক আরও জানায়, এই ধরনের মৃত্যু ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী তদন্তযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। তাই নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত পরিচালনা করা অত্যন্ত জরুরি। একইসঙ্গে উভয় ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ অবিলম্বে প্রকাশ, ভুক্তভোগী পরিবারকে নিরাপত্তা ও আইনগত সহায়তা প্রদান এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানায় সংগঠনটি। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, হেফাজতে মৃত্যুর এমন পুনরাবৃত্তি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা হ্রাস করছে না, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি উদ্বেগজনক সংস্কৃতিকে পুষ্ট করছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকের জীবন, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর উচিত পেশাদারত্ব, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন মানবজমিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আমার চোখে পড়ছে না। আগেও যে অবস্থা ছিল সেটির পুনর্বহাল হয়েছে। আমরা দেখতাম থানা হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলছে। এসব বিষয় এখনো আছে। মাঝখানে ৫ই আগস্টের পর কিছুদিন বন্ধ ছিল। কারণ ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের গুছিয়ে আনতে পারেনি। কিন্তু কয়েকমাসের ভেতরে আমরা দেখছি নির্যাতন করে মেরে ফেলার ঘটনাগুলো সামনে এসেছে। তিনি বলেন, যদিও এখন পর্যন্ত পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে এটা বলা শোভনীয় হবে না। কিন্তু সিস্টেমটা একই রয়েছে। যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ গণ-অভ্যুত্থান করেছিল সেই হিসেবে মানুষ আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আস্থার জায়গা পাচ্ছে না। আগে যা ঘটেছে সে ধরনের ঘটনাই মানুষ অবলোকন করছে নির্বোধের মতো। মানুষের ধারণা তাদের পক্ষে আর কিছু করার নেই। এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হয় না এটা বলা ঠিক হবে না। এটা নির্ভর করে সরকারের পলিসির উপরে। তাদের সদিচ্ছার উপর। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে গণ-অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ডিমরালাইড অবস্থা রয়েছে। তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। ফলে এখানে শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা দোদুল্যমানতা আছে।