প্রথম পাতা
‘২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন হয়েছে’
স্টাফ রিপোর্টার
২৭ জুন ২০২৫, শুক্রবার
২০২৪ সালের নির্বাচন ডামি ও প্রহসনের ছিল বলে স্বীকার করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বলেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া আগামী এক হাজার বছরেও এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে হাবিবুল আউয়াল এসব কথা বলেন। শুনানি শেষে আদালত তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশ দেন।
দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে হাবিবুল আউয়ালকে আদালতে আনা হয়। প্রথমে তাকে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। পরে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটের দিকে তাকে আদালতে তোলা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন।
নির্বাচনের আগে এমন অবস্থা জেনেও আপনি পদত্যাগ করলেন না কেন? বিচারকের এমন প্রশ্নের জবাবে হাবিবুল আউয়াল বলেন, ওই অবস্থায় পদত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। আমার এক বন্ধুও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল পদত্যাগের কথা, আমি বলেছি তুমি যদি আগে বলতা এমন ভয়ঙ্কর নির্বাচন হবে, তাহলে আমি দায়িত্বই নিতাম না। আউয়াল পূর্বের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে বলেন, ৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের তিন মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত ৭৩ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসন পায়। সেই নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না। ক্ষমতার লোভ এমন যে শেখ মুজিবও তা সামলাতে পারেননি। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করে। পরবর্তী সময়ে তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সংবিধান সংশোধন করে। এ সময় পাবলিক প্রসিকিউটর উত্তেজিত হয়ে আদালতকে বলেন, তিনি নিজেকে জাস্টিফাই করছেন। তার এসব বক্তব্য দেয়ার সুযোগ নেই। এ সময় আউয়াল বলেন, জাস্টিফাই না করতে দিলে রিভলবার দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেন। এ সময় উপস্থিত আইনজীবীরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলে এজলাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব তুলে ধরে আউয়াল বলেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া আগামী এক হাজার বছরেও এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আধা ঘণ্টার দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
শুনানিতে যা উঠে আসে
রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। তিনি আদালতকে বলেন, আসামি হাবিবুল আউয়াল ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আমলে ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি এদেশে কলঙ্কজনক একটি নির্বাচন হয়। সেই ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ২/১টি দল ছাড়া আর কেউ অংশ নেয়নি। সেই নির্বাচন ছিল ডামি নির্বাচন, একতরফা, লোক দেখানো ও প্রহসনের নির্বাচন। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিতে পারেননি। তিনি ৫ই আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান। অন্যায় করেছেন বলেই তিনি গা ঢাকা দেন। শুনানিতে ওমর ফারুক আরও বলেন, ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, সারা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে। এত বড় মিথ্যা বলে তিনি কীভাবে তার ফ্যামিলির সামনে মুখ দেখান? ওইদিন সকাল ৮টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ২৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান। তার এক ঘণ্টা পর ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান। অথচ আমরা দেখেছি কেন্দ্রগুলোতে কোনো মানুষ ছিল না। কুকুর-বিড়াল কেন্দ্রে শুয়ে আছে। ওই এক ঘণ্টা তিনি কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে বলেন, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।’ কতোটা হাস্যকর কথাবার্তা। শুনানিতে সরকারি এই কৌঁসুলি আরও বলেন, আসামির বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে আঁতাত করার অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনে থোক বরাদ্দ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি। সংবিধান বহির্ভূত বক্তব্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন। আমরা তার সর্বোচ্চ রিমান্ড প্রার্থনা করছি। এ সময় আউয়াল বলেন, কেউ নির্বাচনে না এলে আমি কি বসে থাকবো?
আসামি পক্ষের আইনজীবী এমিল হাসান রুমেল তার রিমান্ড নামঞ্জুর চেয়ে বলেন, তার বয়স ৭০। তিনি অনেক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। আমরা যেন ফ্যাসিস্ট দমাতে গিয়ে নিজেরা ফ্যাসিস্ট না হয়ে যাই। এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। নির্বাচনটি ডামি ও প্রহসনের নির্বাচন ছিল। এ সময় তাকে থামিয়ে বিচারক বলেন, প্রত্যেক জেলায় নির্বাচনী ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়। যেখানে যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার একজন দায়িত্বে থাকেন। আগে যার ভাতা ছিল ২২ হাজার টাকা, সেটা আপনি ৫ লাখে উন্নীত করেছেন। এতে কি জনগণের টাকা অপচয় হয়নি? এ বিষয়ে তার জানা নেই জানিয়ে বলেন, পাঁচ বছরের মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করে হয়তো ভাতা বাড়ানো হয়েছিল। এরপর বিচারক আবারো বলেন, এই যে ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়েছিল নির্বাচনের সময় কোথাও কি তারা সরজমিন গিয়েছিলেন? তখন আউয়াল বলেন, একজন রিটার্নিং অফিসারের অধীনে ৪-৫টা সংসদীয় আসনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাকে সহযোগিতা করতে আরও ৪-৫ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার থাকেন। একটা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ২ ভাগ দায়িত্ব কমিশনের, বাকি ৯৮ ভাগ দায়িত্ব মাঠপর্যায়ে কাজ করা অফিসারদের।
এর আগে গত ২৫শে জুন রাজধানীর মগবাজার থেকে হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২২শে জুন আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আসামি করে মামলা করে বিএনপি। পরে ২৫শে জুন এ মামলায় নতুন করে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ধারা যুক্ত করা হয়।