প্রথম পাতা
শুভ জন্মদিন ড. মুহাম্মদ ইউনূস
মিয়া সালাহউদ্দিন
২৮ জুন ২০২৫, শনিবার
ভোরের আলো ফোটার পর পরই রাজধানীর রাস্তাঘাটে মানুষের কোলাহল বেড়ে যায়। মানুষ ছুটে চলে কর্মস্থলে। নগরীতে বেড়ে উঠে কর্মজীবী মানুষের পদচারণা। এটা এই নগরীর নিত্যদিনের কথকথা। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত সুউচ্চ গ্রামীণ ব্যাংক দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। গেটের নিরাপত্তা থেকে অফিস জুড়ে ছোটাছুটি-কর্মচাঞ্চল্য। ভবনের ভেতরে বসে আছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা ও ক্ষুদ্রঋণের জনক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার রুমে থরে থরে সাজানো অসংখ্য বই। যেন একটি লাইব্রেরি। পরনে গ্রামীণ চেক পাঞ্জাবি ও কোর্তা। সাধারণ এক অসাধারণ মানুষ। ধীরস্থির ও সংকল্পে অবিচল। সবাই তাকে ‘স্যার’ বলেন। জনগণ তাকে শ্রদ্ধা করেন-ভালোবাসেন। তিনি দারিদ্র্যবিমোচনের ধারণা দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। দারিদ্র্য পাঠাবেন জাদুঘরে।
এবার একটু পেছনে ফিরে যায়। ২০০৬ সালের ১৬ই অক্টোবর পবিত্র রমজান মাস। মিডিয়ায় খবর হচ্ছে ড. ইউনূস ‘নোবেল’ পেয়েছেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রবিত্ত ধারণার প্রেরণার জন্য ‘শান্তিতে নোবেল পুরস্কার’ লাভ করেন। আমি রোজাদার। ছুটে গেলাম গ্রামীণ ব্যাংকে। সেখানে দেখতে পেলাম লোকে লোকারণ্য। এসেছেন রাজনীতিবিদ, কবি-সাংবাদিক, শিক্ষক, পেশাজীবী, শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং গ্রামের সাধারণ মানুষ। সারা দেশ আনন্দে ভাসছে। সেইসঙ্গে তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকও এই সম্মান পেয়েছে। এটা জাতির জন্য গর্ব ও গৌরবের। ওই দিন তিনি দোতলায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সকলকে স্বাগত জানাচ্ছেন। অভিনন্দন গ্রহণ করছেন। আমি তার সামনে এগিয়ে গেলে তিনি আমাকে ডাকলেন “এই মিয়া সালাউদ্দিন এসো”। আমি তার হাতে ফুল তুলে দেই। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
১৯৯৫ সালের কথা। ইতিমধ্যে ক্ষুদ্রঋণ দেশের মানুষের কাছে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। বিনা জামানতে গ্রামীণ মহিলাদের ঋণ দেয়া হচ্ছে। সে সময়ে আমি বাংলাদেশে বেতারে কাজ করি। মনে মনে ভাবলাম তার সান্নিধ্য পাবো ও তার সাক্ষাৎকার নেবো। যথারীতি বেতারের মাইক্রোফোন ও টেপরেকর্ডার নিয়ে ছুটলাম মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাংকে। এর সঙ্গে আমি যুক্ত করি বেতারের দিলওয়ার হাসান, মাসকাওয়াত আহসান ও ফারোহা সুহরাওয়ার্দীকে। এর পরপরই যথারীতি ৫টি সাক্ষাৎকার নেই। একটি সাক্ষাৎকার সাপ্তাহিক ‘রোববার’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশ বেতার একটি ঐতিহ্যবাহী ও বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম। বেতারে ড. ইউনূস-এর সাক্ষাৎকার প্রচার হওয়ার পর দেশের মানুষের কাছে ক্ষুদ্রঋণের গুরুত্ব ও কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়। এখানেই আমার প্রচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। একবার আমি মানিকগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে যেয়ে সরজমিন সারাদিন ঘুরে ঘুরে সেই সব মহিলাদের সঙ্গে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কথা বলি। যারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সংসারের আর্থিক অভাব দূর করেছেন। এরা বাড়িতে হাঁস-মুরগি, গাভী পালন করছেন। কেউ বা আবার ছোটখাটো ব্যবসা করছেন। এই প্রতিবেদন বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রের গ্রামীণ শ্রোতাদের জন্য জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আমার দেশ’-এ প্রচারিত হয়। বর্তমানে ‘আমার দেশ’ অনুষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে। ওই সময় আমার গ্রামীণ ব্যাংকে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। স্যারের সঙ্গে চিঠিপত্র আদান-প্রদান হতো। একটা চিঠিতে আমি লিখেছিলাম স্যার আপনি ‘নোবেল পুরস্কার’ পাচ্ছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর সামাজিক ব্যবসাটি বিশ্বে আলোচিত বিষয়। সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রচলিত ব্যবসার শাস্ত্রে ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার বাইরে ব্যবসার কোনো ক্ষেত্র নেই। অর্থাৎ স্বার্থপর হওয়া ছাড়া ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। সামাজিক ব্যবসা যেহেতু ব্যবসা সেহেতু সেই টাকা ফিরে আসে। একই টাকাকে ব্যবহার করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যায়। সামাজিক ব্যবসাকে নিজস্ব ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। সমাজের যত সমস্যা আছে সবকিছুর সমাধান সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। তিনি আরও বলেন, নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সময় এসেছে। প্রযুক্তি আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদেরকে পথ বের করতেই হবে। সামাজিক ব্যবসা আমাদের মনে আশা জাগায়। হয়তো সামাজিক ব্যবসা আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। এই গন্তব্য হবে সবার জন্য ধন, সবার জন্য পুঁজি, সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য প্রযুক্তি, সবার জন্য সুশাসন, বেকারত্বহীন, দারিদ্র্যহীন, পরিবেশ দূষণমুক্ত, যুদ্ধাগ্রহমুক্ত, শান্তিপূর্ণ আয়ের বৈষম্যহীন এক নতুন পৃথিবী।
১৯৪০ সালের ২৮শে জুন আজকের দিনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় শিকারপুর ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা দুলা মিঞা সওদাগর একজন মহুরী ও মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। সহধর্মিণী অধ্যাপক দিনা আফরোজ। ইউনূসের দুই মেয়ে। তিনি পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। চট্টগ্রামের কলিজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম স্থানলাভ করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করার পর ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি অধ্যাপক হন। ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ভান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে পরে আমেরিকার মার্সিসবোরোতে মিডিল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকাতে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করেন এবং অন্যান্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন সংগ্রহ করতে ‘বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার’ পরিচালনা করেন। দেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সময় ড. ইউনূস দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। সেই সময় তিনি গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৬ সালে পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পটি চালু করেন। ১৯৮৩ সালে এই প্রকল্পটি ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ হিসেবে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে এর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। বাংলাদেশের বাইরেও আমেরিকাসহ গ্রামীণ ব্যাংক পদ্ধতি বিশ্বের ৪০টি দেশে অনুসারী করা হচ্ছে। ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারসহ দেশি ও বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এর মধ্যে সেই সাতজন ব্যক্তির একজন ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন।
ড. ইউনূসের নিজস্ব দর্শন ও আদর্শ আছে। তিনি মনে করেন, দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচি রচনার আগে প্রথমে দারিদ্র্যের বিষয় হবে কতো আন্তরিকভাবে আমরা দারিদ্র্যের অবসান চাই। এ ছাড়া নির্ভেজাল গণতন্ত্র দারিদ্র্য নিরসনের জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে তিনি মনে করেন গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার গড়ে তোলা দারিদ্র্য নিরসনের একটা আদর্শিক শর্ত। স্থানীয় সরকার কাঠামো যত নিচের দিকে শক্তিশালী হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গরিব মানুষের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা ততই বাড়বে। তিনি গ্রাম সরকার কর্মসূচির প্রস্তাব করেন। শহীদ- প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এটি প্রবর্তন করেন।
ভোরের সূর্যটা বাড়তে থাকে। রাজপথে মানুষের সমাগমে ভরে যায়। দিনের পর রাত আসে, বছরের পর বছর আসে। সময়ের চাকা দ্রুতগতিতে চলে। প্রেক্ষিতে গত বছরের জুলাই মাস থেকে ছাত্র-জনতা কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলন ক্ষমতালোভী স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে পরিণত হয়। শেখ হাসিনা দলবলসহ ভারতে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ৮ই আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই কার্যক্রম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার উজ জামান বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
ড. ইউনূস কাজের মানুষ। কাজকে তিনি বড় মনে করেন। কাজই তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আগামী দিনে তিনি সুন্দর, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য উৎসবমুখর নির্বাচন জাতিকে উপহার দিবেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি কাজ করছেন। বাস্তবায়ন করবেন মানবতাবিরোধী আচরণের বিচার, সংস্কার ও জুলাই ঘোষণাপত্রের সমাধান করবেন। ইতিমধ্যে লেখক হিসেবে তার তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। “পথের বাধা সরিয়ে দিন মানুষকে এগুতে দিন” “ব্যাংকার টু দ্যা পাওয়ার” “তিন শূন্য”। এসব গ্রন্থ পাঠক সমাজে দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে। মহান আল্লাহপাকের কাছে তার সুস্থতা কামনা করি। জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন।
লেখক: কবি ও জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যম কর্মী।