শেষের পাতা
সামাজিক ব্যবসা পুরো বিশ্বকে বদলে দিতে পারে
স্টাফ রিপোর্টার
২৮ জুন ২০২৫, শনিবার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সামাজিক ব্যবসা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং পুরো বিশ্বকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীতে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার একমাত্র সঠিক পথ হলো সামাজিক ব্যবসা। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব। শুক্রবার সাভারের জিরাবো সামাজিক কনভেনশন সেন্টারে দু’দিনের ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা সর্বোত্তম পন্থা’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে’ উদ্যাপন করা হচ্ছে। ইউনূস সেন্টার ও গ্রামীণ গ্রুপ যৌথভাবে ১৫তম সামাজিক ব্যবসা দিবসের আয়োজন করেছে। এবারের সম্মেলনে বিশ্বের ৩৮টি দেশ থেকে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তা, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং বিদেশি অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
সামাজিক ব্যবসার রূপান্তর সক্ষম শক্তি এবং এর মাধ্যমে ইতিবাচক টেকসই পরিবর্তন আনার শক্তিশালী উপায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সামাজিক ব্যবসা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং পুরো বিশ্বকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এবং নতুন সভ্যতাও তৈরি করতে পারে। এই ব্যবসার মাধ্যমে একটি সুন্দর ও উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব, যা বর্তমানের হতাশা থেকে মুক্তি এনে তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তর ঘটাতে পারবে।
প্রধান উপদেষ্টা মূল বক্তব্যে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, বিশ্ব একটি ভুল পথে চলছে এবং কেবল নিঃস্বার্থ, ভালো কাজের জন্য স্বপ্নবান হওয়া এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, পৃথিবীতে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার একমাত্র সঠিক পথ হলো সামাজিক ব্যবসা। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব।
তিনি তরুণদের বৈশ্বিক পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে ছোট থেকে শুরু করতে হবে, বড় স্বপ্ন দেখতে হবে এবং একসঙ্গে কাজ করে এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে, যার বৈশিষ্ট্য হবে তিনটি শূন্য- ‘শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য গড় কার্বন নিঃসরণ।’
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, তরুণদের বলবো, ‘যদি তুমি একজন চাকরিপ্রার্থী হও, তবে সেটি আমাদের জন্য লজ্জার। কারণ আমরা তোমাকে নিজেকে আবিষ্কার করার মতো সাহায্য করতে পারিনি। যদি তুমি নিজেকে আবিষ্কার করো তাহলে কখনোই চাকরিপ্রার্থী থাকবে না। তুমি একজন উদ্যোক্তা হয়ে উঠবে। ভারত-পাকিস্তান, ইরান-ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই বছরের প্রেক্ষাপট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। আগের সোশ্যাল বিজনেস ডে-গুলোতে আমরা অনুভব করতাম যে, পৃথিবী একটা আশাব্যঞ্জক দিকে এগোচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম বিশ্বে যুদ্ধের অধ্যায় শেষ হচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম মানব জাতি এখন শান্তিতে বাস করবে। কিন্তু হঠাৎ করেই এই বছর নানা ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। দরিদ্র মানুষ এই যুদ্ধে পিষ্ট হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সামাজিক ব্যবসার বার্তা কী- এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সামাজিক ব্যবসার একটি বার্তা হলো পৃথিবীকে বদলে দেয়ার বার্তা এবং এর জন্য প্রয়োজন প্রতিটি জাতির অংশগ্রহণ, প্রতিটি জাতির উচিত সেইসব সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা যেগুলো তারা এত বছর ধরে তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, এই বার্তাটি খুবই সহজ, যা আমরা বারবার পুনরাবৃত্তি করে আসছি। বার্তাটি হলো- আমরা ভুল পথে চলছি। যদি আমরা এই পথেই এগিয়ে যেতে থাকি, তাহলে আমাদের সবার জন্যই এক বিশাল বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। আমরা তার থেকে রক্ষা পাবো না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা বারবার বিশ্বকে যা বোঝাতে চেয়েছি তা হলো- পুরো পৃথিবী গড়ে উঠেছে মানুষের স্বার্থপরতার একমাত্রিক ভিত্তির ওপর এবং মানুষকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে স্বার্থপর সত্তা হিসেবে। আমরা এর বিরোধিতা করছি। আমরা বলছি, হ্যাঁ, আমাদের ভেতরে স্বার্থপরতা আছে, তবে এটাও ভুলে যাবেন না যে আমাদের ভেতর নিঃস্বার্থ মানসিকতাও আছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সামাজিক ব্যবসা দিবস এক ধরনের পারিবারিক মিলনমেলা, যেখানে সবাই একত্রিত হন পরিবারের সদস্যদের মতো। তিনি বলেন, আপনাদের সবার অনেক গল্প আছে বলার মতো। আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি বক্তৃতা দেয়ার জন্য নয়, বরং নিজেদের অনুপ্রাণিত করার জন্য। আমরা সব সময় আমাদের সামাজিক ব্যবসা দিবসকে একটি উপলক্ষ হিসেবে দেখি, যেখানে আমরা নিজেদের শক্তি পুনরায় আহরণ করি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিশ্বের হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ অসাধারণ কিছু করেছে। তরুণরা আশ্চর্যজনক সব কাজ করেছে। তারা রাস্তায় নেমে এসেছে এবং বলেছে এবার যথেষ্ট হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তরুণরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশকে ‘চরম অন্ধকার থেকে আলোর পথে’ নিয়ে গেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস, জাপানের ইউগ্লিনা জিজি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা মিৎসুরু ইজুমো, বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এনজিআইসি’র সহ-সভাপতি ইসমাইল সেরাগেলদিন, গ্রামীণ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল হাসান, ইউনূস সেন্টারের জনসংযোগ অফিসার জিনাত ইসলাম প্রমুখ।