ঢাকা, ১৭ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৯ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

সেই অস্ত্রধারীরা এখন কোথায়?

জালাল রুমি, চট্টগ্রাম থেকে
১৭ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার
mzamin

মুখে মাস্ক। হাতে শটগান। দলবল নিয়ে ছুটছেন, করছেন গুলিও। নাম তার মো. শামীম। যুবলীগ ক্যাডার হিসেবে চট্টগ্রাম নগরীতে তিনি বেশ পরিচিত। ৪ঠা আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি ও টাইগারপাস এলাকায় গুলি চালাতে দেখা যায় তাকে। সেদিন সিআরবি এলকায় গুলিবিদ্ধ হন সাইফুল ইসলাম আরিফ ও মো. হাসান নামে দুই যুবক। ৫৭ দিন জীবন-মৃত্যুর লড়াই শেষে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর শহীদ হন আরিফ। সর্বশেষ ১০ মাস পর গত ২২শে মে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান হাসানও। এতকিছুর পরও এখনো অধরা অস্ত্রধারী যুবলীগ সন্ত্রাসী। শামীমের মতো অস্ত্রধারী আরও ২০ জন শনাক্ত হলেও তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত হয়েছেন ১০ জন। আন্দোলনে সহিংসতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে নগরীর ১৬টি থানার মধ্যে ৮টি থানায় ৫৭টি মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা। এরমধ্যে কোতোয়ালি থানায় ১৬টি, সদরঘাট থানায় ২টি, বাকলিয়া থানায় ৪টি, খুলশী থানায় ২টি, চান্দগাঁও থানায় ১২টি, পাঁচলাইশ থানায় ১৩টি, ডবলমুরিং থানায় ৮টি এবং হালিশহর থানায় ২টি মামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের আওতাধীন থানাগুলোতে আগস্ট পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলায় মামলা হয়েছে ৮টি। এর বাইরে চট্টগ্রাম আদালতেও প্রায় অর্ধ শতাধিক মামলা করেছে নিহত ও আহতদের পরিবার। এসব মামলায় ১০ মাসে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন।

এদিকে, সহিংসতার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ছবি, ভিডিও ফুটেজ, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে ২০ জন অস্ত্রধারী শনাক্ত করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। এরমধ্যে ১৬ জুলাই মুরাদপুর এলাকায় অস্ত্র হাতে দেখা গেছে যুবলীগ কর্মী ফিরোজ, এইচ এম মিঠু, জাফর এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের দেলোয়ারকে। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি। সেদিন আওয়ামী নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলিতে ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরামসহ তিনজন নিহত হন।
একইদিন নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকায় অস্ত্র ও ককটেল নিয়ে অবস্থান করতে দেখা গেছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর অনুসারীদের। সেখানে একটি সাদা গাড়ি নিয়ে অবস্থান করতে দেখা গেছে যুবলীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরকে। এ সময় অস্ত্র হাতে সেখানে অবস্থান নেন যুবলীগ নেতা আবুল বশর, সোলায়মান বাদশা, নুরুল আজিম রনি ও মেজবাহ উদ্দিন নোবেলের নেতৃত্বে তিনটি গ্রুপ। ছাত্র-জনতার বিপক্ষে দাঁড়ানো তিনটি গ্রুপে ছিলেন মো. হাসান, মো. জুয়েল, মো. জাহেদ, মো. বাপ্পি, শহিদুল্লাহ রনি, শাহাদাত হোসেন বাবু, মো. জাবেদ, জাবেদ হোসেন খান ওরফে খান জাবেদ, মো. মাসুদ ওরফে মাছকাটা মাসুদ, মো. বেলাল, মো. আরিফ, মেয়র গলির মন্টি, এমদাদ হোসেন মানিক, এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল ইসলাম।

এ ছাড়া ১৮ই জুলাই বহদ্দারহাটে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মহিউদ্দিন ফরহাদ, দেলোয়ার, তৌহিদ, আওয়ামী লীগ কর্মী জালাল, যুবলীগ কর্মী ফরিদ, এইচ এম মিঠু ও ফিরোজ। গত ৪ঠা আগস্ট চট্টগ্রামের নিউমার্কেট, তিনপুলের মাথা, স্টেশন রোড ও আসকারদীঘি এলাকায় কমপক্ষে আট-দশজন অস্ত্রধারীকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করতে দেখা গেছে। আসকারদীঘি পাড় এলাকায় জামালখানের ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিতে দেখা গেছে। ওই সময় সেখানে অস্ত্র হাতে উপস্থিত ছিলেন ফরহাদ ইসলাম চৌধুরী রিন্টু। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার ওপর অস্ত্র হাতে হামলার অভিযোগে যুবলীগ নেতা মো. সোলায়মান বাদশা, মো. হাসান, ফয়সাল, ফিরোজ, হাবিবুর রহমান আহনাফসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাকি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে ফোনে জানানো হয়েছে।

এদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সহিসংতার ঘটনায় আওয়ামী লীগের হাজারো চুনোপুঁটি গ্রেপ্তার হলেও উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো রাঘববোয়ালদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী ছাড়া গ্রেপ্তারের তালিকায় আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের তেমন কোনো নেতা নেই।

জানা গেছে, আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে আছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক হুইপ সামসুল হক চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, আবদুচ ছালাম, মুজিবর রহমান, মহিউদ্দিন বাচ্চু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, নগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. এসরারুল হক, জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, চকবাজারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর মোস্তফা টিনু, ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দীন, যুবলীগ নেতা আরশাদুল আলম বাচ্চু, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিসহ অনেকেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৫ই আগস্টের পর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে পালিয়ে যান। ছেলের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করতে গত রমজান মাসে তিনি লন্ডনে যান। সম্প্রতি সেখানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে ভূরিভোজ করতেও দেখা গেছে। লন্ডনে থাকেন আলোচিত সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী প্রায় ৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬২০টি বাড়ি কেনেন। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন বলে জানিয়েছেন তার পক্ষে রাজনীতি করা চট্টগ্রামের সাবেক দুই ছাত্রনেতা। তিনি জানান, ৫ই আগস্ট আ জ ম নাছির চট্টগ্রামেই ছিলেন। সেখান থেকে তিনি সবকিছু ম্যানেজ করে সিঙ্গাপুর ও পরে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান।

৫ই আগস্টের পর সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভারতে পালিয়ে যান। কলকাতায় একটি ভাড়া বাসায় ছিলেন। তার বৃটিশ বংশোদ্ভূত স্ত্রী ও দুই মেয়ে লন্ডনে থাকেন। ধারণা করা হচ্ছে ভারত থেকে তিনি লন্ডনে চলে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। দুইজনের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও এনসিপি’র উত্তরাঞ্চলের সংগঠক রাসেল আহমেদ বলেন, চট্টগ্রামের রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আন্দোলনে ওপেন গুলি চালানো কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন ও যুবলীগ ক্যাডার বাবর এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। সরকার আমাদের হতাশ করেছে। তারা খুনীদের সেইফ এক্সিট দিচ্ছে।

রাঘববোয়ালদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার। তিনি বলেন, পুলিশ কমিশনার বলেন, গত ৯ মাসে অনেক প্রভাবশালীকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ, ফজলে করিম, সাবেক কাউন্সিলর জসিম কি প্রভাবশালী না? সন্ত্রাসী সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। আবার অনেকে আত্মগোপনে আছেন। তাদেরও খুঁজে বের করতে পুলিশ কাজ করছে।

 

পাঠকের মতামত

They are relative of administration. SO NOW TILL AREST.

fastboy
১৭ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার, ১২:০০ অপরাহ্ন

চট্টগ্রামের বিস্তৃত জায়গা ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারীরা নিয়ন্ত্রন করতো। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের বিরাট অংশ ধরা ছোয়ার বাইরে এবং স্বাভাবিক চলাফেরা করছে।

Farid
১৭ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার, ৯:০৪ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status