ঢাকা, ৮ মে ২০২৪, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

লিবিয়ার জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেতে দুই তরুণের আকুতি

প্রতীক ওমর, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
১৪ আগস্ট ২০২২, রবিবার
mzamin

নরসিংদীর দৌলত মিয়া এবং গাইবান্ধার ফিরোজ কবির। মানব পাচারকারী চক্রের মূল হোতা সাদ্দাম বাহিনীর হাতে এখনো জিম্মি হয়ে আছেন। অবৈধভাবে লিবিয়ায় নিয়ে তাদের আটকে রেখে শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছেন সাদ্দাম হোসেন। ৬০/৭০ হাজার টাকার চাকরি দেয়ার প্রলোভনে ওই তরুণদের লিবিয়া পাঠায় সাদ্দাম। ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে তাদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালায় সাদ্দাম। তারপর জিম্মি করে দেশে থাকা পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। সম্প্রতি মানবজমিনের এই প্রতিবেদক লিবিয়ায় জিম্মিদশায় আটকে থাকাদের নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। দেশে থাকা পরিবারগুলোর দেয়া তথ্যসূত্র ধরেই বিভিন্ন জেলায় সরজমিন গিয়ে সন্ধান মেলে অসংখ্য ভুক্তভোগী পরিবারের। প্রথম পর্বের প্রতিবেদনে সাদ্দামের মানুষ বিক্রির লোমহর্ষক কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়েছিল। এ পর্বে লিবিয়ায় এখনো জিম্মি হয়ে আছেন দুই তরুণ দৌলত মিয়া এবং ফিরোজের বর্ণনায় তাদের করুণ দশার চিত্র তুলে ধরা হলো।

বিজ্ঞাপন
 সাদ্দাম চক্রের হাতে লিবিয়ায় এখনো জিম্মি আছেন বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার মহিসাসুড়া গ্রামের মোকলেছ মিয়ার ছেলে দৌলত মিয়া। 

তিনি একটি ভিডিও বার্তায় এই প্রতিবেদককে জানান, তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ। দৌলত জানান, সাদ্দাম তাকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে প্রথমে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেয়। এরপর অবৈধভাবে প্রথমে ভারত তারপর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে দুবাই, মিশর হয়ে লিবিয়া নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে প্রথমে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়। এরপর মরুভূমির মধ্যে তাদের নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে আটকে অমানবিক নির্যাতন চালায়। দেশ থেকে আসার আগে এবং লিবিয়ায় জিম্মি করার পর মোট ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায় করে সাদ্দাম। এরপর তাকে শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেয় সাদ্দাম। বর্তমানে দৌলত খেয়ে না খেয়ে কোনোরকম জীবন বাঁচিয়ে রেখেছেন লিবিয়ায়। তাকে দিয়ে অমানবিক কাজ করানো হচ্ছে। দেশে আসার মতো টাকা এবং সুযোগ কোনো কিছুই এখন তার আয়ত্বে নেই। বুকফাঁটা আর্তনাদে এখন সে চিৎকার করছে দেশে ফেরার জন্য। এজন্য বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই সম্বব নয়। দৌলতের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হলে তিনি আরও বলেন, কারও সঙ্গে কথা বলা দেখলে তাকে নির্যাতন করা হবে। তিনি গোপনে তার ভিডিও বক্তব্যটি এই প্রতিবেদকে পাঠিয়েছেন। একই অবস্থায় জিম্মি আরেক তরুণ গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কচুয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন  টুকুর ছেলে ফিরোজ কবির।

 তিনিও ছোট তিন সন্তান মা বাবার কাছে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে আছেন। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা তিনিও ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন। ফিরোজ বলেন, সাদ্দাম তাকে অবৈধভাবে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার কথা বললে আমি রাজি হয়ে যাই। এরপর পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু ঠিক করি। সাদ্দাম তখন প্রথমে ভারতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে দুবাই নিয়ে যায় তাকে। দুবাইয়ে ১০ দিন বিভিন্ন স্থানে রাখে। তারপর মিশরে নেয়। মিশরে একদিন অবস্থানের পর তাকে লিবিয়া নেয়া হয়। লিবিয়া পৌঁছার পর একই কায়দায় দৌলতের মতো তারও পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়। এরপর মরুভূমির মধ্যে সাদ্দাম বাহিনীর বন্দিশালায় আটকে রেখে প্রতিদিন মারপিট করে। বিদ্যুতের শক দিয়েও নির্যাতন চালায় সাদ্দাম। এরপর ফিরোজের পরিবারকে আরও টাকা পাঠানোর জন্য তাগিদ দেয় সাদ্দাম। টাকা না দিলে মেরে ফেলা হবে এমন হুমকির পর দেশ থেতে আবারো টাকা পাঠানো হয়। টাকা পাওয়ার পর ফিরোজকেও শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেয় সাদ্দাম। এরপর দুই বছর শ্রমিকের কাজ করে একটি টাকাও হাতে পায়নি ফিরোজ। দুই বছর পর সেখান থেকে পালিয়ে অন্য একটি জায়গায় মানবেতর অবস্থায় রয়েছেন ফিরোজ। 

দেশে আসার কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে তিনিও হতাশায় ভুগছেন। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ করেছেন তিনি তাকে যেন দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়।  কথা হয় ফিরোজ কবিরের পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন  টুকু, মা চামেলী বেগম এবং  স্ত্রী  মৌসুমী আক্তারের সঙ্গে। তারা কান্নাভেজা কণ্ঠে ফিরোজের করুণ দশার কথা উল্লেখ করেন। বলেন, সাদ্দাম বর্তমানে দেশে আছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও গ্রেপ্তার হচ্ছে না। দেশে ফিরেও থেমে নেই সাদ্দাম। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হয়রানি করছে। স্ত্রী  মৌসুমী বলেন, তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে বিদেশের মরুভূমিতে খেয়ে না খেয়ে আছে। তার এমন করুণ পরিস্থিতে আমরাও দেশে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। ছোট ছোট ৩ সন্তান নিয়ে আমরাও খুব খারাপ অবস্থায় আছি। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ধার-দেনা করে তাকে বিদেশে পাঠানো হয়। 

সাদ্দামের খপ্পরে পড়ে আমাদের এখন সব শেষ। সন্তানদের ভালো খাওয়াতে পারি না, পড়ালেখা করাতে পারছি না। তিনিও তার স্বামীকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের শুভ দৃষ্টি কামনা করেছেন।   ফিরোজের ১১ বছর বয়সী মেয়ে নুশরাত জাহান মুন, ৮ বছর বয়সী মেয়ে মাইশা আক্তার এবং ৩ বছর বয়সী ছেলে মিনহাজ পিতাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। প্রতিরাতেই বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলে। বাবাকে আসতে বলে। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও দেশে ফেরার পরিস্থিতি হয়নি ফিরোজের।  সাদ্দামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার আগ কচুয়া গ্রামে। তার পিতা মৃত আনসার আলী সরকার। সাদ্দাম তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো বরাবরেই অস্বীকার করেছে। সাদ্দামের সহযোগী আপন ছোট ভাই মহিদুল ইসলাম সরকার, স্ত্রী মুক্তি বেগম, ভাগিনা অনিকসহ আরও বেশকিছু দালালের নাম উঠে এসেছে।    

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status