শেষের পাতা
ইন্টার্ন চিকিৎসকের বর্ণনা
দুই সেকেন্ডও সময় দেয়নি, কিল-ঘুষি মারতে থাকে
ফাহিমা আক্তার সুমি
১৪ আগস্ট ২০২২, রবিবারসেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিউটি শেষে রুমে আসি। খাওয়া-দাওয়া শেষে বিশ্রাম নেই। সন্ধ্যা ৭টায় কলেজের রিডিং রুমে যাই। সেখানে রাত ৯টা পর্যন্ত বই পড়ি। সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে মনে হলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। হাসপাতালের বহিঃবিভাগের গেট থেকে বেরিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদির পাশে বসি। কিছুক্ষণ পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সংবলিত টি-শার্ট পরা দু-তিনজন শিক্ষার্থী এসে জিজ্ঞেস করে আমি কী করি। তাদের মেডিকেলের স্টুডেন্ট পরিচয় দেই। এরপর তারা নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে। আইডি কার্ড দেখাতে বলে।
তিনি গত মঙ্গলবার রাতে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও বুধবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হকের কাছে লিখিত অভিযোগও দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসামিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথা জানান ভুক্তভোগী এই চিকিৎসককে। এদিকে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ দোষীদের শনাক্ত করতে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন দোষীদের শনাক্ত করতে না পারায় বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে সংগঠনটি। এখনো সেটি চলমান রয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি ডা. মহিউদ্দিন জিলানী বলেন, ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা হয়ে যাওয়ার পর আরও কিছু সময় দিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো প্রশাসন কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি।
এজন্য আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে কর্মবিরতি ঘোষণা করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত দোষীদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না ততক্ষণ আমাদের এই কর্মবিরতি চলবে। ভুক্তভোগী চিকিৎসক সাজ্জাদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমাকে মারতে মারতে ফুটপাথে নিয়ে যায়। একজনের পর একজন মারতেই থাকে। হঠাৎ একজন আমার কানের নিচে জোরে থাপ্পড় মারে। এরপর আমি সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে পড়ে যাই। তখন আমার কাছে আরেকজন এসে বলে এখনো বসে আছিস কেন? এই কথা বলে সে তার পায়ের জুতাসহ আমার কপাল এবং মুখ বরাবর লাথি মারে। লাথিসহ যে যেভাবে পেরেছে পনের বিশটার মতো কিল, ঘুষি থাপ্পড় দিয়েছে। মারার সময় আমি কিছু বুঝতে পারিনি যে আমার চোখে কিছু হয়েছে। লাথির পর আমার নাক থেকে রক্ত পড়তে থাকে। আমি ডান কানে কম শুনতে পাচ্ছি। এরপর আমাকে মারতে মারতে রিকশায় তুলে দেয়। রিকশাচালককে ধমক দিয়ে বলে যেখানে বলেছি সেখানে নিয়ে যা। এরপর আমি বকশিবাজার সিগনালে এসে আমার রুমমেটকে ফোন দেই। তাকে বলি আমার অবস্থা খারাপ আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এরপর তারা আমাকে রুমে নিয়ে আসে। সেখানে এসে দেখে আমার নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তখন আমাকে মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়।
এরপর চিকিৎসক আমাকে ইএনটিতে রেফার করে। সেখানে আমার কানের এবং কানের পরীক্ষা করানো হয়। দুই নাকের মাঝখানে ফেটে যাওয়ায় ব্লিডিং হয়। কানে রক্ত জমাট হয়ে থাকে। পরদিন সকাল থেকে আমার চোখে রক্ত জমাট হতে শুরু করে। চোখের নিচে কালো হয়ে যায়। এরপর বহিঃবিভাগে গেলে চিকিৎসক বলেন, চোখে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আর চোখের নিচে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এরপর আবার আমি নাক, কান গলা বিভাগে যাই সেখানের চিকিৎসক আমাকে বলেছেন কানে একটা ছিদ্র হয়েছে। এখন আমার চোখে খুব ব্যথা হয়। ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছে। ডান কানে আমি এখনো কম শুনতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, ওইদিন আমার সঙ্গে যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটেছে তার জন্য আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। ঘুমালেও আমি মারধরগুলো স্বপ্ন দেখতেছি। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফজলে রাব্বি হলের ১৭ নম্বর রুমে থাকি। কে-৭৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়। বাবা ও মা দু’জনেই শিক্ষকতা করেন।
দুই ভাইবোনের মধ্যে আমি বড়। এই ঘটনায় আমাদের ডিরেক্টর স্যারকে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়। তিনি ঢাবির ভিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। ভিসি স্যারও আমাদেরকে ডাকেন। ভিসি স্যারের সঙ্গে আমরা সরাসরি কথা বলি এবং লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে জানাই। তারা সবাই আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। হামলাকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সংবলিত টি-শার্ট পরা ছিলেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিয়েছেন। তাদের কাউকে চিনতে পারিনি আমি। এই ঘটনা যে শুধু আমার সঙ্গে ঘটেছে তা নয় কিন্তু। এই বিষয়টা হয়তো কেউ লজ্জায় বলতে পারে না। আমি চাই এই রকম ঘটনা যেন আর না ঘটে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, অপরাধীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা বৃহস্পতিবার থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী জানান, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। এ ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ জড়িত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। পুলিশের সহযোগিতায় অপরাধীদের গ্রেপ্তারের আশা করছেন। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরের ঘটনায় আসামিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।