প্রথম পাতা
সাম্য খুন, বিচারের দাবিতে উত্তাল ঢাবি
স্টাফ রিপোর্টার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার
১৫ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার ঘটনায় উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গতকাল এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দিনভর প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। দাবি জানানো হয় দ্রুত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনার। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের দাবিও জানান শিক্ষার্থীরা। ওদিকে ক্যাম্পাসে সাম্যকে শেষ বিদায় জানিয়েছেন সহপাঠী ও সহকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই খুনের ঘটনায় ওই এলাকার নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে সাম্যকে টার্গেট করেই হত্যা করা হয়েছে।
এই খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নিহত সাম্যর মেজো ভাই শরীফুল ইসলাম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় যে হত্যা মামলা করেছেন ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ঢাকায় অভিযান চালিয়ে গতকাল সকালে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলো-মাদারীপুর সদরের এরশাদ হাওলাদারের ছেলে মো. তামিম হাওলাদার (৩০), কালাম সরদারের ছেলে পলাশ সরদার (৩০) ও ডাসার থানার যতীন্দ্রনাথ মল্লিকের ছেলে সম্রাট মল্লিক (২৮)। সাম্যের ভাইয়ের করা মামলায় আসামির সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জন।
গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ বলছে, তুচ্ছ ঘটনায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গ্রেপ্তাররা বহিরাগত ও মাদকাসক্ত। কিছুদিন আগে মাদারীপুর থেকে ঢাকায় এসে ফার্মগেটের ফুটপাথে গেঞ্জির ব্যবসা শুরু করে। নেশা করার জন্য তারা প্রায়ই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাতায়াত করতো। ঘটনার দিনও গিয়েছিল। সাম্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে পড়তেন। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায়। তিনি এফ রহমান হলের ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। সাম্য হত্যার পরপরই সহপাঠী, ছাত্রদল ও শিক্ষকরা তার হত্যার প্রতিবাদ এবং বিচারের বিক্ষোভ মিছিল করেছে। বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পুলিশ ও নিহতের সহপাঠীদের কাছ থেকে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে সাম্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুক্তমঞ্চের পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। এ সময় অন্য একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে তার মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগে। এ সময় তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সেটি ধস্তাধস্তি পর্যন্ত চলে যায়। একপর্যায়ে অন্য মোটরসাইকেলে থাকা ঘাতকরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ খালিদ মনসুর জানিয়েছেন, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে দু’জন ঘটনাস্থলে ছিল বলে শনাক্ত করে আমাদের জানিয়েছে সাম্যর বন্ধু। ঘটনার সময় দুইজন আহত হয়ে শেরেবাংলা নগর থানা এলাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল সেখান থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডে এনে তাদেরকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সাম্য নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঘটনার পরপরই তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মোসাদ্দেক আলী ইবনে মুহাম্মদ এবং এবি জুবায়েরের নেতৃত্বে গভীর রাতেই বিক্ষোভ মিছিল হয়। ছাত্রদলের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল হয়। ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ এই মিছিল নিয়ে ভিসি’র বাসভবন অবরোধ করেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির সঙ্গে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের কথা কাটাকাটিও হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খান এবং প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দীন আহমেদকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করে তাদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ছাত্রদল। বিক্ষোভে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, গতকাল ঢাবি শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য যে নৃশংসভাবে হত্যা হয়েছে, তাতে আমরা বলতে পারি, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়। এর আগেও ক্যাম্পাসে মানসিক বিকারগ্রস্ত তোফাজ্জল হত্যার শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি ও প্রক্টর কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। আমরা অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করছি। একই সঙ্গে আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছি।
ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়েছে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ঢাবি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল এক বিবৃতিতে জানায়, চব্বিশের ফ্যাসিবাদীবিরোধী ও শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। যে ছেলেটি স্বপ্ন দেখেছিল পরিবর্তনের, যে লড়াই করেছিল মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য- গণঅভ্যুত্থানের সেই সম্মুখযোদ্ধা সাম্যকেই তার নিজের ক্যাম্পাসে প্রাণ দিতে হলো। আমরা অবিলম্বে খুনিদের গ্রেপ্তার চাই, বিচার চাই, জবাবদিহিতা চাই। ব্যর্থ প্রশাসন নয়, আমরা নিরাপদ ক্যাম্পাস ও সুরক্ষিত বাংলাদেশ চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, রাতেই তিনজনকে গ্রেপ্তার করে মামলা করা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে কঠোর ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবো। ইতিপূর্বে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট বন্ধ করে দিয়েছিলাম, ভাসমান দোকানগুলোকে উচ্ছেদ করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সেগুলো আবার আগের মতো হয়ে গেছে। এখন চেষ্টা করবো উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে দেয়ার জন্য যাতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আর না ঘটে।
গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলনেতা শাহ্রিয়ার আলম সাম্য (২৫)-এর মৃত্যুর ঘটনায় গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না আত্মীয়স্বজনসহ এলাকাবাসী। সাম্য বেলকুচি উপজেলার সড়াতৈল গ্রামের ফরহাদ সরদারের ছেলে ও ঢাবি’র শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের মাস্টার্সের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এছাড়া তিনি স্যার এএফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন ও এই হলের ২২২ নম্বর রুমে থাকতেন। বুধবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত সাম্য উল্লাপাড়ার মোমেনা আলী বিজ্ঞান স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। তার মা কয়েক বছর আগে মারা যান। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তাদের পরিবারের সবাই ঢাকায় বসবাস করেন।
নিহতের চাচা কাউসার আলম বলেন, সাম্যদের পরিবারের সবাই ঈদ ও বিশেষ কোনো আয়োজনে গ্রামে আসতো। গত মঙ্গলবার (১৩ই মে) রাত ১টার দিকে জানতে পারি সাম্যকে ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে খুন করা হয়েছে। জানি না কোন অপরাধে তাকে খুন করা হলো। মরদেহ ময়নাতদন্ত হওয়ার পর ঢাকায় জানাজা হবে। এরপর গ্রামের বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হবে। স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, সড়াতৈল জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে তার জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। মরদেহ এলে জানাজা শেষে দাফন কার্য শেষ করা হবে। বেলকুচি থানার ওসি জাকেরিয়া হোসেন বলেন, প্রথমে ঢাকায় জানাজা শেষে নিজ গ্রামের বাড়িতে আনা হচ্ছে। বাদ আছর নামাজের পরে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হবে। মরদেহ এলে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হবে।
এদিকে, তার হত্যার প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্রদলের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এ সময় হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারসহ ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা। প্রসঙ্গ, মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান মুক্তমঞ্চের পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল যাওয়ার সময় আরেকটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং ধস্তাধস্তি হয়। এর জেরে সাম্যকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে রাত ১২টার দিকে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
পাঠকের মতামত
একজন স্টুডেন্ট রাত ১২টার পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুক্তমঞ্চ এলাকায় পড়ালেখা করতে গিয়েছিলো মনে হচ্ছে। ওখানে আবার কথা কাটাকাটি এবং ধস্তাধস্তি করে বোল্ড আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসে। এতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দোষ, ওনারা রাতভর দেখুক কোন ছাত্র একাকী কোথায় মাস্তানী করতে যাচ্ছে। আর কট খেয়ে ফিরে আসলেই প্রশাসনের দোষ।