ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কান্না(২)

চাকরি বাজারে মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকেন তারা

পিয়াস সরকার
১২ আগস্ট ২০২২, শুক্রবার
mzamin

সৌরভ সাহার বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই। গত তিন বছর থেকে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে হতাশ তিনি। আপ্রাণ চেষ্টা করেও মিলছে না চাকরি। আবার অনার্স শেষ না হওয়া শিক্ষার্থীরাও ভুগছেন ভবিষ্যৎ চিন্তায়। হারিয়ে ফেলছেন আত্মবিশ্বাস।  রাকিব হাসান থাকেন ফার্মগেটের একটি মেসে। অনার্স শেষ হয়েছে তার প্রায় ৪ বছর। চাকরিহীন অবস্থায় ভয়াবহ দিন পার করছেন তিনি। পড়েছেন সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে।

বিজ্ঞাপন
বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্ল্যাপুরে। বাবা ছিলেন, প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও মা গৃহিণী। সামান্য কিছু আবাদি জমি আর বাবার পেনশনের টাকা দিয়েই চলছে সংসার। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। আর ছোট বোন পড়ছে স্নাতকে। ভয়াবহ অভাবে কাটে তাদের দিন। এরই মাঝে দিতে হয় রাকিবকে টাকা। রাকিব বলেন, কি করবো বলেন? অনার্স শেষ করার পরেও নিজের চলার মতো একটা চাকরি জোটাতে পারছি না।  এইচএসসি পাসের পর রাকিবের ইচ্ছা ছিল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার। সুযোগ হয়নি। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার ছিল না সামর্থ্য। পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, কেন যে ভর্তি হয়েছিলাম? অনার্সে ভর্তি না হয়ে যদি ব্যবসা শুরু করতাম সেটাই ভালো হতো।  প্রায় প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫টি ইন্টারভিউ দেন। কিন্তু সোনার হরিণ সমতুল্য চাকরির দেখা মেলে না।

 এখন কীভাবে কাটছে তার দিন? বলেন, কারও কাছে হাত পেতে চলতে পারলে হয়তো তাই করতাম। বাবা-মায়ের কাছে টাকা নিতাম না। একটি টিউশনি থেকে আসে আড়াই হাজার টাকা। আমার মাসে খরচ প্রায় ৮-১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা বাবা পাঠান। আমি জানি কতোটা কষ্ট করে আমাকে টাকা পাঠান। আগে মিথ্যা বলেও টাকা নিতাম কলেজে থাকা অবস্থায়। আর এখন প্রয়োজনের টাকাটাও চাই না। বাবা নিজে থেকেই পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কেন মিলছে না যোগ্য চাকরি? জবাবে ফাহমিদ হাসিব বলেন, আমরা যখন চাকরি পরীক্ষা দিতে যাই সেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা থাকে। তারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেখানে যান। আমাদের সেটা কম থাকে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাকরি বিষয়ে পূর্ব থেকেই অভিজ্ঞ থাকে। তিনি বলেন, আমি বাংলার শিক্ষার্থী। আমি জানিই না কোথায় আমার আবেদন করতে হবে? আমার যদি প্রাকটিক্যাল বিষয়ে পড়ালেখা হতো তাহলে আগে থেকে আমি সেসব চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতাম। আমার যেহেতু লেখাপড়ার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো চাকরি নেই তাই সব জায়গায় এপ্লাই করছি।  বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষের পর চাকরিতে যোগদান করতে পারেন মাত্র ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। আবার তাদের মধ্যে ৬২ শতাংশই লেখাপড়া করেছেন ব্যবসায় প্রশাসন থেকে।

 এই পরিসংখ্যান থেকেও অনুমেয় প্রাকটিক্যাল বিষয়ে লেখাপড়া করায় এগিয়ে আছেন তারা। কিন্তু অন্য বিষয়ের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছেন ঢের। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন প্রায় ২৯ লাখ শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী লেখাপড়া শেষে চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়েন কেন? এই বিষয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে এইচআর ডিপার্টমেন্টের প্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ পোস্টের জন্য লোক চাইলে আবেদন আসে ২০০ থেকে ৩০০। সেখান থেকে আমরা যোগ্য লোক খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু দেখা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো করেন তুলনামূলক। আর বেসরকারি বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা টেকনিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা থাকে বেশি। আমরাও চাই যোগ্য লোককে বাছাই করতে। তাই হয়তো তারা পিছিয়ে যান। সাবরিনা সুলতানা জ্যোতি। তিনিও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাড়ি তার নীলফামারী জেলায়। বাবা কৃষক। আর বড় ভাইয়ের আছে একটি ওষুধের দোকান। চার ভাইবোনের পরিবারে লেখাপাড়া করতে পারেননি কেউ। তিনিই একমাত্র অনার্স পাস করেছেন। তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দেয়া হলো। এরপর চাকরির জন্য উঠে পড়ে লাগলাম।

 একবার এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রিসিপশনিস্টের জন্য আবেদন করলাম। পরে দেখলাম রিসিপশনিস্টের জন্য ব্যবসায় প্রশাসন থেকে একজন ও ইংরেজি বিভাগের একজনকে নিয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন ইসলামের ইতিহাস পড়ে যদি রিসিপশনিস্টের চাকরি না পাই তবে এই বিষয় রাখার প্রয়োজনটা কি? তিনি আরেকটি চাকরির পরীক্ষার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেন, কিছুদিন আগে একটি আইটি ফার্মে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তারা লোক নেবে ১০ জন, ১ জন রিসিপশনিস্ট। পরীক্ষা দিয়েছি ২৬ জন। ভাইভার দিন কোনো প্রশ্ন না করেই নাম ঠিকানা শুনেই শেষ করে দেন ভাইভা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’- প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে ২০১৭ সালে। পৌঁছে গেছে ১২.৮ শতাংশে। আর উচ্চ শিক্ষিতদের মাঝে বেকারত্ব ১০.৭ শতাংশ। যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মাঝে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের দেশে বেকার ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। যা আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পায় ৮৭ হাজার। প্রতি বছর শ্রমবাজারে ১৩ লাখ মানুষ প্রবেশ করে। আর প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীর মাঝে ৪৭ শতাংশই বেকার থেকে যাচ্ছেন।

 পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওই পরিসংখ্যানে আরও বলা হয়, দেশে মাত্র কাজ করছেন ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ। সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স ৩০ পেরিয়েছে সাকিব হাসান সৈকতের। বাস্তবে আরও ৩ বছর বেশি। তিনি বলেন, আম্মা বিয়ের জন্য চাপ দিতে দিতে বলাই ছেড়ে দিয়েছেন। এখন কোনোরকম টিউশনি করে দিন কাটছে। কিন্তু কতোদিন চলবে এভাবে? বিয়ে করাটাও জরুরি। শারীরিকভাবে সক্ষম হলেও অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম। ছাত্র জীবনে কখনো নেশার সঙ্গে জড়াননি। তবে এখন সিগারেট তার সঙ্গী। ভুগছেন ভয়াবহ হতাশায়। আবার সিনিয়রদের দেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী অনার্স শেষ করার আগেই ভুগছেন হতাশায়। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্নের পর পাবলিকে সুযোগ না পেয়ে ভর্তি হই তেঁজগাও সরকারি কলেজে। কিন্তু যেভাবে বড় ভাইয়েরা হতাশায় ভুগছেন তা দেখে ভয় করে। ইচ্ছা আছে সম্মানের সঙ্গে অনার্স শেষ করবো। কিন্তু আমি চিন্তিত এর ভবিষ্যৎ কি? হতাশার পাশাপাশি অনেকে আবার ভালোও করছেন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছেন। বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন।

 সাফল্য পাওয়া এসব শিক্ষার্র্র্র্র্র্র্র্র্থীরা বলছেন, নিজস্ব চেষ্টা এবং পরিকল্পনার কারণে তারা সফলতা অর্জন করেছেন।  কথা হয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফাহমিদা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সামাজিক-মানসিক প্রশান্তি ও সমাজে টিকে থাকার জন্য একটা সম্মানজনক কাজ খুবই জরুরি। এটি না থাকলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়াটাই স্বাভাবিক। তৈরি হয় বিষণ্নতা। এই বেকারত্বের কারণে নিজেকে গুটিয়ে নেন তারা। পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। ফলে সম্ভাবনা তৈরি হয় নেশার জগতে জড়িয়ে পড়ার। দ্বিধাগ্রস্ত, অকারণে রেগে যাওয়া, বিশ্বাসহীনতা ও সর্বোপরি অন্যায় পথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয় তাদের মধ্যে। তবে চাকরির বাজারের বাইরে উদ্যোক্তা তৈরিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢের এগিয়ে। অনার্সে তাদের পড়াশোনার চাপ কম থাকায় অনেকেই সময়টা কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন। পেয়েছেন সফলতা। শাকিল চৌধুরী বলেন, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই কলেজ বিমুখ। করোনাকালে বসে না থেকে অনলাইন ব্যবসা শুরু করি ‘সেইফ হাউজ’। তিনি বলেন, কলেজ না থাকায় যেমন অপকার হয়েছে। আবার এই সময়টা কাজে লাগিয়ে একটা ব্যবসার পেছনে সময় দিচ্ছি।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status