শেষের পাতা
নিরাপদ রুট সিলেট
দুবাইয়ের জালাল ও নোমান চক্রের দখলে স্বর্ণের চোরাচালান
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
২৬ এপ্রিল ২০২৫, শনিবারদুবাইয়ে বসে সিলেটের স্বর্ণের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে জালাল ও নোমান সিন্ডিকেট। দু’দেশেই তাদের রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে আসা এসব স্বর্ণের চালান তারা সীমান্ত দিয়ে পাঠিয়ে দেয় ভারতে। বেশির ভাগ চালানই ওসমানী দিয়ে খালাস করা হয়। দুবাই থেকে আসা পর পর কয়েকটি স্বর্ণের চালান আটকের পর তাদের নাম এসেছে আলোচনায়। এ নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। গতকালও ওই সিন্ডিকেটের বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের চালান সিলেটে আটক হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে ওসমানী বিমানবন্দরে প্রায় ৪ মণ স্বর্ণের চালান আটক হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আটককৃত স্বর্ণের বেশির ভাগেরই মালিক জালাল ও নোমান চক্র। বাহক দিয়ে স্বর্ণের চোরাকারবার করার কারণে তারা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। স্বর্ণ চোরাকারবার সিন্ডিকেটের প্রধান হচ্ছে জালাল আহমদ। তার বাড়ি গোয়াইনঘাটের সোনারবাংলা এলাকার বীরকুলী গ্রামে। ২০১৩-১৪ এর দিকে জীবিকার তাগিদে জালাল দুবাইয়ে পাড়ি জমান। প্রথমে একটি কোম্পানিতে চাকরি করলেও পরে ২০১৬-১৭ এর দিকে সে জড়িয়ে পড়ে স্বর্ণ চোরাচালানে। ডেরা দুবাইয়ে বসবাসকারী জালাল আহমদ দুবাই ও সিলেটে স্বর্ণের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়েছে। এই নেটওয়ার্কে রয়েছে একই গ্রামের মঞ্জুর আহমদ, আলমগীর মিয়া, ফারুক আহমদ ও তার ভাগিনা গোলাম আম্বিয়া। এর মধ্যে মঞ্জুর, আলমগীর ও ফারুক দুবাইয়ে আসা-যাওয়া করে। তবে তারা মালামাল বহন করে না। বড় চালানের বাহককে নজরে রাখতে তারা যাত্রী সেজে ওই ফ্লাইটে সিলেটে আসে। দেশে স্বর্ণের চালান গ্রহণ ও ভারতে পাচারে ব্যবস্থা করে সিলেটে থাকা গোলাম আম্বিয়া। স্থানীয় সূত্র জানায়, গোয়াইনঘাটের পান্থুমাই এলাকার রাজা মিয়া, ভাদেশ্বর এলাকার আব্দুল করিম, আব্দুল মতিন ও হাসান আহমদ সীমান্তে স্বর্ণ চোরাকাবরারি নামে পরিচিত। তারাও জালাল সিন্ডিকেটের সদস্য। তাদের হাত ধরেই দুবাই থেকে আসা স্বর্ণের চালান পান্থুমাই সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত ১০ বছর ধরে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণের বড় চালান পাঠায় জালাল আহমদ। তার সঙ্গে বিমানবন্দরের এভিয়েশনের একটি গ্রুপের আঁতাত রয়েছে। ওই গ্রুপের ম্যাসেজে তারা ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচার করে। গত চার মাস আগে স্বর্ণের বড় একটি চালান সহ দুইজনকে আটক করা হয়েছিল। পরে তাদের বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট থানায় মামলা করা হয়। ওই স্বর্ণের চালান আটকের পর পুলিশ গ্রেপ্তারকৃতদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় স্বর্ণ বহনকারীরা পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। তবে তাদের কাছ থেকে বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন এয়ারপোর্ট থানার ওসি সৈয়দ আনিসুর রহমান। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সিলেটের কানেকশনে কারা কারা সম্পৃক্ত সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। স্বর্ণের চালানের সঙ্গে অনেক সময় বহনকারী আটক হয়। চোরাকারবারিরা আড়ালে থেকে এসব কাজ করে। গোয়াইনঘাটের বীরকুল গ্রামের জালাল আহমদ দুবাইয়ে কী করেন এ সম্পর্কে দুবাই প্রবাসী কয়েকজন সিলেটি নাগরিক জানিয়েছেন, জালাল এখন ডেরা দুবাইয়ের পরিচিত ব্যবসায়ী। তার একটি টেলিকম ব্যবসা ছিল। স্বর্ণ চোরাচালান করে সে দুবাইয়ে চারটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে। সে ১০ বছরের গোল্ডেন ভিসায় পরিবার সহ দুবাইয়ে বসবাস করছে। তার ভাই ফারুকের নামে আরেকটি ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। এখন ফারুকের নামে গোল্ডেন ভিসা বের করার চেষ্টা চলছে। ফারুক দেশে ছিল। সম্প্রতি সে দুবাইয়ে গেছে। সিলেট নগরের খাসদবির এলাকায় জালাল চার তলা একটি ভবন নির্মাণ করছেন। ওই ভবন নির্মাণে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। জালাল ও ফারুকের ভাগিনা গোলাম আম্বিয়া। সে দেশেই আছে। শুক্রবার তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে সে নিজেকে আম্বিয়া বলে পরিচয় দেয়। সাংবাদিক শোনা মাত্র সে নিজের পরিচয় সুমন নামে দেয়। বাড়ি বিছনাকান্দি বলেও জানান। জালাল, ফারুক নামে কারও সঙ্গে তার পরিচয় নেই বলেও জানান। সিলেটে স্বর্ণের আরেকটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে নোমান আহমদ। তার বাড়ি দক্ষিণ সুরমার কাইস্তারাইল এলাকায়।
নোমানও দুবাইয়ে ডেরা দুবাইয়ে বসবাস করে। জালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিলে প্রায় সময় তারা স্বর্ণের চালান দেশে পাঠায়। দেশে থাকা নোমানের আত্মীয় নগরের সাপ্লাই এলাকার অনিক তার দেশে তার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। নোমান ২০১৬-১৭ সালের দিকে দুবাইয়ে যায়। বাড়িতে আসা-যাওয়া কম করে। তার সিন্ডিকেটে রয়েছে গোলাপগঞ্জ এলাকার শাহরিয়ার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার ওবায়দুল্লাহ ও তার ভাই আব্দুল্লাহ। তারা স্বর্ণের চালান নিয়ে দুবাইয়ে যাতায়াত করে। প্রায় চার বছর আগে নোমানের বাহক শেখঘাটের জাহেদ আহমদ ৬০টি স্বর্ণের বার নিয়ে ওসমানীতে ধরা পড়েছিল। সূত্র বলছে, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা স্বর্ণের চালানের বেশির ভাগই খালাস হয় নগরের খাসদবির ও সাপ্লাই এলাকায়। স্বর্ণের ব্যবসার সঙ্গে তারা হুন্ডির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বে আম্বরখানা ও খাসদবির কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের একটি গ্রুপে নেতারা স্বর্ণ সিন্ডিকেটের প্রধান জালালের প্রায় ৫০ লাখ টাকা লুটে নিয়েছিল। ধরা পড়ার ভয়ে জালাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা পুলিশে অভিযোগ করেননি। দুবাই প্রবাসীরা জানিয়েছেন, স্বর্ণ চালান বহনের জন্য জালাল ও নোমান সিন্ডিকেট বিভিন্ন কোম্পানির বাঙালি শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। যখনই কেউ দেশে আসতে চায় তখন তাকে স্বর্ণ বহনের প্রস্তাব দেয়া হয়। এজন্য তার দুবাইয়ের রিটার্ন টিকিট ফ্রি ও নগর ৫০০ থেকে ১ হাজার দিরহাম দেয়া হয়। বড় চালান হলে তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যরা ফ্লাইটে বাহককে নজরদারি করে। চালান ধরা পড়লে তারা সটকে যায়। এভাবে তাদের চালান বহন করতে গিয়ে ১০-১২ জন শ্রমিক আটক হয়েছেন। প্রথমে সিন্ডিকেট সদস্যরা তাদের দেখভাল করলেও পরে মামলার গ্লানি ওই প্রবাসী ও তার পরিবারকে বহন করতে হচ্ছে।
আলীম গ্রেপ্তার: আলীম উদ্দিন দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী ছিলেন। তার বাড়ি গোয়াইনঘাটে হলেও তিনি রাজধানী ঢাকায় অবতরণের টিকিট করেছিলেন। সে জালাল সিন্ডিকেটের স্বর্ণের চালান বহন করছিল। অবতরণের পর গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাকে উড়োজাহাজের ভেতর থেকে নামিয়ে আনেন কাস্টমস ও এনএসআইয়ের গোয়েন্দারা। পরে স্ক্যানারে পরীক্ষার মাধ্যমে তার পরিধেয় কাপড়ে স্বর্ণ গলিয়ে আনার বিষয়টি ধরা পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি বিষয়টি স্বীকার করেন। এ সময় আলীমের পরিহিত চারটি অন্তর্বাস, দু’টি গেঞ্জি, একটি শার্ট, প্যান্টসহ আটটি কাপড় জব্দ করা হয়। ওই ব্যক্তির পরিধেয় একাধিক কাপড়ে মেলে স্বর্ণের অস্তিত্ব। পরে এগুলো জব্দ করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার আরেক কর্মকর্তা জানান, আলীমের সঙ্গে একই বিমানে আরেকজন স্বর্ণ চোরাচালানকারী ছিলেন। তাকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে। সিলেট কাস্টমসের সহকারী কমিশনার (অতিরিক্ত দায়িত্ব বিমানবন্দর ও এয়ারফ্রেইট বিভাগ) ইনজামাম উল হক জানিয়েছেন, আলীম উদ্দিন একসঙ্গে কয়েকটি অন্তর্বাস ও গেঞ্জি পরে এসেছিলেন, সেগুলোতে স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া ছিল। তার পরিহিত কাপড়গুলো পুড়িয়ে স্বর্ণগুলো উদ্ধার করা হবে। কাপড় পোড়ানো না হলে কতো পরিমাণ স্বর্ণ আছে, সেটি জানা যাবে না। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পরিধেয় কাপড়ে প্রায় এক কেজি স্বর্ণ তিনি এনেছেন।