ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা কি পাকিস্তানের জন্য বড় হুমকি

মানবজমিন ডিজিটাল

(৪ ঘন্টা আগে) ২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার, ৩:২৬ অপরাহ্ন

mzamin

কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে গত মঙ্গলবার পর্যটকদের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এরপরই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক হ্রাস করেছে ভারত এবং বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত, যা পাকিস্তানে পানি সরবরাহকে মারাত্মকভাবে কমতে পারে।

ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে তার প্রধান স্থল সীমান্তও বন্ধ করে দিয়েছে এবং বর্তমানে ভারতে থাকা কিছু পাকিস্তানি নাগরিককে দেশ ছাড়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার ভারতের বিরুদ্ধে একই ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয় পাকিস্তান এবং উভয় দেশের মধ্যে সকল দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করার হুমকি দেয়। যার মধ্যে ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তিও অন্তর্ভুক্ত।

পাকিস্তানের সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে শিমলা চুক্তিসহ সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত রাখার অধিকার রয়েছে তাদের। যতক্ষণ না ভারত পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসকে উস্কানি দেয়া, আন্তর্জাতিক হত্যাকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক আইন ভাঙা বন্ধ না করছে, তত দিন এই চুক্তি স্থগিত থাকতে পারে। সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার  হুমকিতে পাকিস্তান বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ। তারা ভারতকে সতর্ক করে দিয়েছে যে পানি সরবরাহে যেকোনো ব্যাঘাতকে ‘যুদ্ধের পদক্ষেপ’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং তারা পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে।  

সিন্ধু পানি চুক্তি একটি আন্তঃসীমান্ত পানি  চুক্তি যা দুই দেশকে সিন্ধু অববাহিকা থেকে প্রবাহিত পানি ভাগাভাগি করার অনুমতি দেয়। গত ৬৫ বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত এবং প্রায় অবিরাম উত্তেজনার মধ্যেও এই চুক্তিতে প্রভাব পড়েনি। যদিও ভারত ২০১৯ সালে চুক্তিটি স্থগিত করার দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলো তবুও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

ভারত কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল

কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনকারী ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী মঙ্গলবার ভারত-শাসিত কাশ্মীরের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পহেলগাঁওয়ে হামলার দায় স্বীকার করেছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পূর্বে দাবি করেছে, টিআরএফ হল পাকিস্তান ভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈইবার একটি শাখা। ভারত দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে যে পাকিস্তান কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহকে সমর্থন করে, যদিও ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বুধবার ভারত দাবি করেছে যে পহেলগাঁও হামলার সঙ্গে সীমান্ত সীমার বাইরের সংযোগ রয়েছে এবং এর জন্য ভারত তার পশ্চিমের  প্রতিবেশী দেশটিকে দায়ী করেছে।

বুধবার ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত থাকবে যতক্ষণ না পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাখ্যান করছে।

এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ভারত প্রতিটি ‘সন্ত্রাসী’ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করবে এবং শাস্তি দেবে।

সিন্ধু পানি চুক্তি কী?

১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু পানি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অতিরিক্ত স্বাক্ষরকারী হিসেবে উপস্থিত ছিল বিশ্ব ব্যাংকও। এই চুক্তিতে সিন্ধু নদী এবং এর উপনদীগুলোর পানি দুই দেশের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে ভাগ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। চুক্তির অধীনে তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী বিয়াস, রাভি ও শতদ্রুর পানি ভারতকে এবং তিনটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী চেনাব, সিন্ধু ও ঝিলমের পানি পাকিস্তানকে বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই চুক্তি উভয় দেশকে নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্যে একে অপরের নদী ব্যবহারের অনুমতি দেয়, যেমন ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প যেখানে খুব কম বা একেবারেই পানি সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয় না।

এই চুক্তি অনুসারে, তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী বিয়াস, রাভি ও শতদ্রুর পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ ভারতকে দেয়া হয়, যার গড় বার্ষিক প্রবাহ ৪১ বিলিয়ন বর্গমিটার (৩৩ মিলিয়ন একরফুট)। তেমনই পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী সিন্ধু, চেনাব ও ঝিলমের পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানকে দেয়া হয়, যার গড় বার্ষিক প্রবাহ ৯৯ বিলিয়ন বর্গমিটার (৩৩ মিলিয়ন একরফুট)। অন্যদিকে, সিন্ধু নদীর দ্বারা বহন করা মোট পানির  প্রায় ৩০% ভারত পেত, আর বাকি ৭০% পাকিস্তান পেত। এই চুক্তি ভারতকে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর পানি সীমিত পর্যায়ে সেচের জন্য এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ চলাচল, মাছ চাষ ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেয়।

এই চুক্তি স্থগিত করার ফলে পাকিস্তানের কী হবে

এটি ভারতের দিক থেকে হুমকি স্বরূপ। তারা যখনই ইচ্ছা সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পানি পাকিস্তানে প্রবাহিত করতে বাধা দিতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে ভারত অবিলম্বে নদী প্রবাহ সীমিত করার পরিকল্পনা করছে। এমনকি যদি ভারত চায়, তবুও চুক্তি থেকে তার অংশগ্রহণ স্থগিত করা সত্ত্বেও তাৎক্ষণিকভাবে পানি প্রবাহ বন্ধ করার সম্ভাবনা কম। এর কারণ হল, ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর উজানে জলাধার তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু তাদের জলাধারের ক্ষমতা পর্যাপ্ত নয়। যখন মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে হিমবাহের বরফ গলে যায় তখন পানির স্তর উচ্চ থাকে। তাই সেই পানি  সম্পূর্ণরূপে আটকে রাখার জন্য ক্ষমতা জলাধারগুলোর নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিবেশগত অধ্যয়নের সহকারী অধ্যাপক হাসান এফ খান আল জাজিরাকে বলছেন, পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলো খুব বেশি প্রবাহিত হয়, মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। ভারতে বর্তমানে সেই নদী প্রবাহকে ব্যাপকভাবে সংরক্ষণ করার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। তবে, যদি ভারত পানির প্রবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করে অথবা কমিয়ে দেয়, তাহলে পাকিস্তান শুকনো মরশুমে পানির সমস্যায় পড়বে। পাকিস্তান তার কৃষিকাজ এবং শক্তির জন্য পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। পাকিস্তানে পানির বিকল্প উৎস নেই।

২০২৪ সালে প্রকাশিত পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক জরিপ অনুসারে, পাকিস্তানের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক, যেখানে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান ২৪ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে ৩৭.৪ শতাংশ। দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, জনসংখ্যার বেশিরভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের মতে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ২৪৭.৫ মিলিয়ন।

ভারতের কি এই চুক্তি স্থগিত করার ক্ষমতা আছে

ভারত চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করলেও আইনি  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারা একতরফাভাবে চুক্তিটি স্থগিত করতে পারে না। পাকিস্তানি আইনজীবী আহমের বিলাল সুফি আল জাজিরাকে বলেছেন, ভারত ‘অ্যাবেয়েন্স’ শব্দটি ব্যবহার করেছে এবং এই চুক্তি স্থগিত রাখার কোনও বিধান নেই। চুক্তিটি কেবলমাত্র দু’পক্ষের পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমেই সংশোধন করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে এটি উচ্চ এবং নিম্ন নদী সম্পর্কিত প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যেখানে পানির বণ্টন বন্ধ রাখা যায় না।

নয়াদিল্লির রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনুত্তমা ব্যানার্জি আল জাজিরাকে বলেছেন, চুক্তিটি চলতে পারে, কিন্তু বর্তমানে যেভাবে চলছে সেভাবে নয়। পরিবর্তে, এটি ‘সংশোধন’, ‘পর্যালোচনা’ ও ‘পরিবর্তন’-তিনটি করা হতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানির হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মূল চুক্তিতে পূরণ করা হয়নি।

টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হাসান এফ খানের মতে, সিন্ধু পানি  চুক্তি একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি যার কোনও মনোনীত প্রয়োগকারী সংস্থা নেই। যদিও বিশ্বব্যাংকের নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ এবং সালিসকারী নিয়োগের ভূমিকা রয়েছে, এটি কোনও প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নয়।

খান ব্যাখ্যা করে বলেন, যদি পাকিস্তান আইনি আশ্রয় নিতে চায়, তাহলে সম্ভবত তা আন্তর্জাতিক আদালতের মতো  ফোরামের মাধ্যমেই হতে হবে।   এক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি ও সুনাম দুটোই ক্ষুণ্ন হতে পারে। সূত্র: আলজাজিরা

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status