অনলাইন
পহেলগাঁও হামলার জের
পাকিস্তানের সঙ্গে স্থলসীমান্ত বন্ধ এবং পানিবণ্টন চুক্তি বাতিল করলো ভারত
মানবজমিন ডিজিটাল
(২ সপ্তাহ আগে) ২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১:২০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫৯ অপরাহ্ন
কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলসীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। একইসঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তি বাতিল এবং ভিসা ছাড় প্রকল্পের অধীনে পাকিস্তানের নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে দেশটি।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ‘যারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে তাদের এবং পর্দার আড়ালে থাকা ব্যক্তিদেরও দ্রুত জবাবদিহি করা হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাসের ঘোষণা দিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘‘নিরাপত্তা নিয়ে মন্ত্রিসভার একটি বিশেষ বৈঠকে হামলার সঙ্গে সীমান্তের আন্তঃসংযোগের বিষয়টি ‘উল্লেখযোগ্যভাবে’ তুলে ধরা হয়, যার পরে স্থলসীমান্ত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।’’
মিশ্রি বলেন, ‘ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত রাখছে যতক্ষণ না পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাখ্যান করছে।’ যদিও পাকিস্তান এই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ বৃহস্পতিবার জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন।’
মঙ্গলবারের হামলায় কমপক্ষে ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর বুধবার কাশ্মীর জুড়ে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী তৎপর হয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ হামলাকারীদের ধরতে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। ১৯৮৯ সালে ভারত-বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে জঙ্গি সহিংসতা বেড়েছে। মঙ্গলবারের হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন, জঙ্গিরা পর্যটকদের জড়ো করে উপস্থিত পুরুষদের ‘ইসলামিক আয়াত পড়তে’ বলেছিল। যারা পারেনি তাদের হত্যা করে জঙ্গিরা।
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা আশাভরি জগদালে, যিনি হামলায় তার বাবা ও চাচাকে হারিয়েছেন। স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গুলি শুরু হওয়ার সময় তিনি ও তার পরিবার অন্যান্য পর্যটকদের সঙ্গে কাছের একটি তাঁবুতে লুকিয়ে ছিলেন। আশাভরি বলেন, ‘জঙ্গিরা যখন আমাদের তাঁবুতে পৌঁছায়, তখন তারা আমার বাবা সন্তোষ জগদালেকে বাইরে টেনে এনে ইসলামিক আয়াত পাঠ করতে বলে। যখন তিনি তা করতে ব্যর্থ হন, তখন তারা তাকে তিনটি গুলি করে। একটি মাথায়, একটি কানের পেছনে এবং একটি পিঠে। আমার চাচা আমার পাশে ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তাকেও চার থেকে পাঁচটি গুলি করে।’
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজ্যের একটি মুসলিম পাড়ায় বেড়ে ওঠা দেবাশীষ ভট্টাচার্য রয়টার্সকে বলেছেন, ‘তিনি ইসলামিক আয়াতের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে তাকে রেহাই দেয়া হয়েছিল। জঙ্গিরা তাকে এবং আশপাশের লোকদের হাঁটু গেড়ে বসতে নির্দেশ দেয় এবং যখন অন্যরা শ্লোকগুলো উচ্চারণ করতে শুরু করেন, তখন তিনিও তাদের অনুসরণ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি শ্লোকগুলো জানতাম এবং সেই মুহূর্তে সম্ভবত এটাই ছিল আমাদের জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায়। যারা ব্যর্থ হয়েছিল তাদের হত্যা করা হয়েছিল।’ বন্দুকধারীরা চলে যাওয়ার পর তারা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে প্রাণ বাঁচান।
একটি স্বল্প পরিচিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে ৮৫ হাজারের বেশি ‘বহিরাগত’ এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে, যা ‘জনসংখ্যাগত পরিবর্তন’ এর কারণ। পহেলগাঁওতে নিহতদের মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নাগরিক ছিলেন। ২০০৮ সালের মুম্বাই গুলিবর্ষণের পর এটি ছিল ভারতে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরবের দুই দিনের সফর সংক্ষিপ্ত করে বুধবার সকালে দিল্লিতে ফিরে আসেন। তিনি বিমানবন্দরে তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। পরে বুধবার একটি বিশেষ নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকা হয়।
এই ঘটনাটিকে আঞ্চলিক সংঘাতের একটি বড় উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে পর্যটকদের লক্ষ্য করে আক্রমণের ঘটনা বিরল। সর্বশেষ প্রাণঘাতী হামলাটি ঘটে ২০২৪ সালের জুনে। জঙ্গি হামলায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি বাস গভীর খাদে পড়ে যায়। কমপক্ষে নয়জন নিহত এবং ৩৩ জন আহত হন। ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ দাবি করেছে, মঙ্গলবার যাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে তারা সাধারণ পর্যটক ছিল না; বরং তারা ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল। এই হামলার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে কাশ্মীর থেকে পর্যটকদের সরিয়ে দেয়া হয় । স্থানীয় গণমাধ্যমে দেখা যায়, পর্যটকরা তাদের ব্যাগ ট্যাক্সিতে তুলে শ্রীনগরের হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছেন।
দিল্লির একজন পর্যটক সমীর ভরদ্বাজ সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে কাশ্মীরে ভ্রমণে যেতে পারি? আমাদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা কেবল তখনই ভ্রমণ করতে পারি যদি আমাদের মন শান্ত থাকে কিন্তু এখন পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ।
পহেলগাঁওয়ের ট্যাক্সি ড্রাইভার গুলজার আহমেদ বলেন, ‘এই হামলা আমাদের কাজের ওপর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আমরা প্রাণহানির বিষয়ে বেশি চিন্তিত। ভবিষ্যতে আমরা যা-ই করি না কেন, এই হামলায় আমাদের পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেতে হবে, যাতে কেউ আবার এই ধরনের কাজ করার সাহস না পায়। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের চার দিনের ভারত সফরের সময় এই হামলাটি ঘটে। তিনি এটিকে ‘বিধ্বংসী সন্ত্রাসী হামলা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন, পহেলগাঁওয়ে মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার পর (কাশ্মীর) উপত্যকা থেকে আমাদের অতিথিদের চলে যাওয়া হৃদয় বিদারক।
২০১৯ সালে মোদি এবং তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার কর্মী ও রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে পাঠিয়ে একতরফাভাবে কাশ্মীরের সীমিত স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে। এরপর থেকে বিতর্কিত হিমালয় অঞ্চলে হিন্দুদের, যার মধ্যে অন্যান্য ভারতীয় রাজ্য থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকরাও রয়েছেন, তাদের লক্ষ্য করে হত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোদি সরকার কাশ্মীরকে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে, সেটা হলো-জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। সেইসঙ্গে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বহিরাগতদের আবাসিক প্রশংসাপত্র প্রদানের অনুমতি দেয়া হয়, যার ফলে তারা চাকরির জন্য আবেদন এবং জমি কিনতে সক্ষম হয়। তারপর থেকে এই অঞ্চলে নাগরিক স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র শাফকাত খান ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘পাকিস্তান পর্যটকদের প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন।’ সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান