অনলাইন
ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি খোলা চিঠি
‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভুল করার সময় নেই’
কাউসার মুমিন, যুক্তরাষ্ট্র
(২ দিন আগে) ৭ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ৯:১৫ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৪:৪৫ অপরাহ্ন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন নিক্কেই, এডিটোরিয়াল বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান আকিও ফুজি। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন শুল্ক নীতি আরোপ করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় দেশ ও চীন পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যার ফলে বিশ্ব এখন এক বাণিজ্য যুদ্ধের মুখোমুখি উল্লেখ করে আকিও ফুজি লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভুল করার সময় নেই। চিঠিতে তিনি বলেন-
প্রিয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প,
আপনি দায়িত্ব নেয়ার মাত্র দুই মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র এতটা বদলে যাবে—তা বিশ্বাস করা কঠিন। আমার ধারণা, শুধু আমিই এমনটা ভাবছি না। আপনি জানুয়ারিতে আপনার উদ্বোধনী ভাষণে যেই ‘সাধারণ জ্ঞানের বিপ্লব’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন—এবং এর ফলে বিশ্বজুড়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
আপনি এমনকি আপনার মিত্র ও বন্ধুদেরও আক্রমণ করেছেন, বলেছেন, ‘একদিন, হয়তো ওরা আর আমাদের মিত্র থাকবে না।’ আপনি আরও বলেছেন, ‘আমি বলি—বন্ধু হোক বা শত্রু, অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধুরাই শত্রুর চেয়ে খারাপ।’
এই অবস্থার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো শুল্কনীতি। বুধবার যেদিন আপনি ‘মুক্তি দিবস’ বললেন, সেদিনই এশিয়া, ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে ১৯৩০-এর দশকের পর সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করা হলো। ইউরোপীয় দেশ ও চীন পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যার ফলে বিশ্ব এখন এক বাণিজ্য যুদ্ধের মুখোমুখি।
আপনি বলেন শুল্ক ‘সুন্দর’। কিন্তু অনেক অর্থনীতিবিদ সতর্ক করে দিয়েছেন যে, পাল্টাপাল্টি শুল্ক বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
উচ্চ শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের জন্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটাবে, যার ফলে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’— অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সংকোচন—এর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আপনি বলছেন, বাজার সাময়িকভাবে সমন্বয় করতে হবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যদি একঘরে হতে চায়, তার প্রভাব খাটো করে দেখা হবে ভুল।
আমি বুঝি কেন ‘হিলবিলি এলেজি’ বইয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্স যে রাষ্ট্রীয় অবক্ষয় ও দুর্দশার ছবি এঁকেছেন, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাস্ট বেল্ট’-এর মানুষের বাস্তবতা তুলে ধরে। তাদের সমর্থনে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্ট যদি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ করেন, সেটা যৌক্তিক। সব দেশই নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। কিন্তু বর্তমান নীতিগুলো আসলেই আমেরিকার স্বার্থে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মনে হচ্ছে আপনি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যেতে চান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছিল, যার মধ্যে ছিল মার্শাল পরিকল্পনা এবং ইয়েনকে ডলারের বিপরীতে ৩৬০ রেটে নির্ধারণ করা।
১৯৭০-এর দশকে যখন জাপান ও জার্মানি অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছিল, তখন নিক্সন প্রশাসন এই নির্ধারিত বিনিময় হার বাতিল করে দেয়। এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র মাঝে মাঝে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ও মুদ্রার মান সামঞ্জস্য করলেও যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি বজায় রেখেছে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বৈশ্বিকীকরণ আরও বেগ পায়, যার ফলে নতুন অনেক দেশ বৈশ্বিক বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। চীন ও অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতিগুলো দ্রুত প্রবৃদ্ধি লাভ করে, ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের উৎপাদকরা খরচের দিক থেকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে এবং কঠিন সমন্বয়মূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। তবে একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভব ঘটে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানির এবং শেল গ্যাস বিপ্লবের মাধ্যমে দেশটি নেট জ্বালানি রপ্তানিকারকে পরিণত হয়।
আপনি মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ঘাটতি ও উৎপাদন খাতে দুর্বলতার কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির একজন বিজয়ী।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট কর্তৃক প্রণীত ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড কম্পেটিটিভনেস র্যাংকিং অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ১২তম প্রতিযোগিতাশীল দেশ, যা জি৭-এর অন্য সব দেশ ও চীনের চেয়েও এগিয়ে। আমেরিকান কোম্পানি ও বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা। ফোর্বসের শীর্ষ দশ ধনীর তালিকায় আটজনই আমেরিকান, যার মধ্যে আপনার মিত্র এলন মাস্কও রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উচিত মাদক সমস্যা বা গ্রামীণ অর্থনীতির অবক্ষয় মোকাবিলায় শুল্ক নয়, বরং সম্পদ পুনর্বণ্টন, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা–ভিত্তিক ঘরোয়া নীতি গ্রহণ করা। শুল্কের ফলে মূল্যবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সংকট সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর এবং ধনী-দরিদ্র ব্যবধান আরও বাড়বে। অন্য দেশের ওপর আক্রমণ বুমেরাংয়ের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই ফিরে আসবে, যেমন এখন কানাডা ও ইউরোপে আমেরিকান পণ্যের বিরুদ্ধে বয়কট দেখা যাচ্ছে।
১৯৮৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি খোলা চিঠিতে আপনি লিখেছিলেন, ‘দশক ধরে, জাপানসহ অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকিয়ে যাচ্ছে।’
আপনি লিখেছিলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে, জাপানিরা, যারা নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যয়ে কিছুই খরচ করে না (যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সেটা ফ্রি-তে করছে) এক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তুলেছে।’
প্রায় ৪০ বছর পরেও আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়নি বলেই মনে হচ্ছে।
এদিকে, জাপান এখন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা অবস্থানের খরচে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। তারা আইন সংশোধন করে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সম্মিলিত আত্মরক্ষা অনুমোদন দিয়েছে এবং জিডিপির ২% পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছে। চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে, জাপান-মার্কিন জোট একতরফা সম্পর্ক থেকে রূপান্তরিত হয়ে এখন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র যদি জাপান ও ইউরোপের আরও সক্রিয় ভূমিকা চায়, তা যৌক্তিক। কিন্তু অর্থনৈতিক আক্রমণ মিত্রতা জোরদার করবে না বরং আমেরিকার সফট পাওয়ারকে দুর্বল করবে এবং ডলারকে শীর্ষ রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে হুমকির মুখে ফেলবে।
আপনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমেরিকাকে আবার ‘মহান’ করবেন। কিন্তু আমেরিকা মহান হয়েছিল কারণ এটি যুদ্ধোত্তর বিশ্ব ব্যবস্থার নেতৃত্ব দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যিনি আপনার মতোই ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’-তে বিশ্বাস করতেন তিনিও স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। অথচ আপনি এসব নীতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
‘আমেরিকানদের ওপর সবসময় ভরসা করা যায় সঠিক কাজটি করার জন্য তবে, তারা সব ভুলভাল করে ফেলার পর।’ উইনস্টন চার্চিলের এই বিখ্যাত উক্তিটি এ মুহূর্তে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভুল করার সময় নেই।
একজন বন্ধুর দৃষ্টিকোণ থেকে, আমি আন্তরিকভাবে চাই—যুক্তরাষ্ট্র যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবতা উপলব্ধি করুক।
বিনীত,
আকিও ফুজি
নির্বাহী চেয়ারম্যান, এডিটোরিয়াল বোর্ড, নিক্কেই
(সূত্র: নিক্কেই এশিয়া)
পাঠকের মতামত
সুন্দর অনুবাদ, ধন্যবাদ মানবজমিন।
বাংলাদেশ পাসপোর্ট থেকে পূর্বের ন্যায় ইসরাইল নামটা সরিয়ে ফেলার এখনই উপযুক্ত সময় এবং Interim Government এর কাছে এজন্য জোর দাবি জানাচ্ছি! কুটনৈতিকভাবে অন্তত এতটুকু করার সক্ষমতা আমাদের অবশ্যই আছে।