ঢাকা, ২৬ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ১২ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫ রমজান ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

চাকরি কেন সোনার হরিণ

আরিফুল ইসলাম
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবারmzamin

চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তা দিনদিন বেড়েই চলছে। ৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে শেষ হয় আওয়ামী লীগের শাসনের। ক্ষমতায় থাকাকালে প্রতিটি সেক্টরে অনিয়ম, দুর্নীতি করে নিজের ও দলের নেতাকর্মীদের নিয়োগ দিয়েছেন নানা উপায়ে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও দেশে শঙ্কা বিরাজ করছে চাকরির বাজার নিয়ে। জুলাই আন্দোলনের ছাত্র-জনতার যে স্পিরিট তা ধরে রেখেছে তারুণ্য। এদের বেশির ভাগ অংশই চাকরির বাজারে প্রবেশ নিয়ে কথা বলছেন। এরমধ্যে শেখ হাসিনার আমলে হওয়া অনেকগুলো চাকরির নিয়োগ বাতিল করেছে বর্তমান সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা না গেলে আমরা সংকটে পড়ে যেতে পারি। দেশে এখনো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি না হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ছাত্র-জনতার চাওয়া বেশি। তাদেরকে সঠিকভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করে দিতে না পারলে দেশ সংকটে পড়বে। সরকারি চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা একজন শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয় চাকরির পড়াশোনার পেছনে। সরকারি চাকরির মধ্যে সবার টার্গেট থাকে বিসিএস। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে অনেকেই এখন বিসিএস বিমুখ হচ্ছেন। এ ছাড়া অন্যান্য চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায় তা বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে নিরুৎসাহিত করছে। নিয়মিত সরকারি চাকরির সার্কুলার না হওয়া, যথাসময়ে পরীক্ষা ও নিয়োগ নিয়ে শঙ্কিত থাকেন তারা। যার ফলশ্রুতিতে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষার কোর্স কারিকুলামের সঙ্গে বাস্তব কর্মক্ষেত্রের যোগসাজশ না থাকাও অন্যতম কারণ চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ার। বেসরকারি চাকরির মধ্যে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি বেশি। প্রতিনিয়ত টেকনোলজির সঙ্গে নিজেকে আপডেট করতে হয়। বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক কলকারখানা, বেকার হয়ে পড়ছেন দেশের অনেক মানুষ। এসব মানুষের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করা, শিল্পের অস্থিরতা কাটিয়ে বন্ধ কলকারখানা চালু করতে উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে এখন ২৬ লাখ ৬০ হাজার। আর বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৪.৪৯ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে তা ছিল ৪.০৭ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে দেশে বেকার জনগোষ্ঠী ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেকার বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত ১৯তম আইসিএলএস বেকারত্বের এই হার প্রকাশ করেছে।

শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে যে হারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে। সে অনুপাতে শিক্ষার মান বাড়েনি। শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে ক্লাসের শিক্ষণরীতি ও বাস্তব বা কর্মক্ষেত্রে এর প্রয়োগে তেমন কার্যকারিতা না থাকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পরও চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ার কারণে হতাশায় ভুগছেন তারা। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর সকলের প্রস্তুতি ও আশা থাকে সরকারি চাকরি নিয়ে। সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলাও অন্যতম কারণ। এভাবে দিনের পর দিন চলার কারণেই আমাদের শিক্ষিত সমাজের বেশির ভাগ মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার চেষ্টা করছে তারুণ্যকে কাজে লাগানোর। তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে দেশে সরকারি চাকরির বাজারও খুব বেশি নেই। কর্মসংস্থানের জন্য বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রসারতা ও উদ্যোক্তা হওয়ার বিকল্প নেই বলেও জানান তারা।
চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করার পরও একজন তরুণ চাকরির  বাকি অংশ ২৭ পৃষ্ঠায়
পেছনে ঘুরতে ঘুরতে তার জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই চলে যায়। চাকরির দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও জটিলতাও এর অন্যতম কারণ। দলীয় রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় তো রয়েছেই। এজন্য বেশির ভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এখন দেশের বাইরে যাচ্ছে। যারা দেশে রয়েছেন তাদেরও চিন্তা এখন বাইরে চলে যাওয়া। এভাবে মেধাবীরা দেশের বাইরে কেন চলে যাচ্ছে। তা নিয়ে কেউই কনসার্ন না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টেকনোলজিক্যাল বিষয়ে এআই নিয়ে গবেষণা ও উন্নত পড়াশোনা হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতাও দরকার। এদিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না বলেও জানান তিনি।

নীলক্ষেত মোড়ে কথা হয় সিলেট এমসি কলেজের শিক্ষার্থী মো. হাসানুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিদেশমুখী হওয়ার কারণে দেশের চাকরির বাজার ভালো না। নানা রকম চাপ আর অস্থিরতা। দেখা যায় মাস্টার্স শেষ করেও চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে সময় শেষ হয়ে যায়। তবুও কাঙ্ক্ষিত চাকরি মেলে না। বিদেশে গিয়ে অল্প সময়ে দেশের থেকে ভালো ডেভেলপ করা যায়। তাহলে কে থাকবে দেশে? 

তিনি আরও বলেন, দেশের বেশির ভাগ তরুণ আমরা লেস প্রোডাক্টিভ (সৃজনশীলতা কম)। আমাদের দেশের শিক্ষার কারিকুলামের সঙ্গে চাকরির কারিকুলামের তেমন কোনো যোগসূত্র নেই। যার কারণে চাকরি করতে গেলে চায় অভিজ্ঞ মানুষ। শিক্ষিত তরুণরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। বর্তমানে চাকরির সংকট চলছেই এটা বলতে হবে। গবেষণার যে কাজটা করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সে কাজটা অন্য সব প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের মানুষগুলো করছেন। এখানে অর্থনৈতিক একটি বিষয় জড়িত। যার কারণে অর্থের দিকে আকৃষ্ট হয়ে উচ্চ পর্যায়ের সেসব মানুষগুলো নিজেরাই এগুলো করছেন। যার কারণে শিক্ষিত তরুণরা পিছিয়ে পড়ছে বলেও জানান তিনি।

কম্পিউটার সায়েন্সে মৌলভীবাজার পলিটেকনিক থেকে পাস করা মহিম উদ্দিন বলেন, ডিপ্লোমা শেষ করে চাকরি পেতে অনেক ভোগান্তি। যে সার্কুলারগুলো আসে তাও যথেষ্ট না। যেসব শিক্ষার্থী আমরা পাস করে প্রতি বছর বের হই। চাকরির জন্য কয়েকদিন চেষ্টা করেছি। পরে ভেবেচিন্তে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। যে সময়ে দেশে বিএসসি করবো তারপরও থাকবে চাকরির অনিশ্চয়তা। তার থেকে দেশের বাইরে গেলে অল্প সময়ে নিজেকে তৈরি করতে পারবো। মূলত দেশের এই অবস্থার কারণেই শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণরা ইউরোপ, আমেরিকাসহ দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যাচ্ছে। এর কারণে দেশে এক ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু দিনশেষে কিছু করার থাকবে না বলেও জানান তিনি। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহ আলম বলেন, আরও ২ বছর আগে লেখাপড়া শেষ করেছি। এখন চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে বাড়ির মানুষ কল দিলে কথা বলতেও লজ্জা লাগে। সরকারি চাকরির জন্য এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি। বেসরকারি চাকরির নিশ্চিয়তা না থাকায় শিক্ষার্থীরা শুরুতেই যেতে চান না। কিছু ব্যাংক ও বিসিএসে আবেদন করে যাচ্ছি একের পর এক। সরকার পরিবর্তনের ফলে একটা অস্থিতি রয়েছে দেশে। এরজন্য নতুন সার্কুলার হচ্ছে কম। আগের সার্কুলারের পরীক্ষাগুলোও সময়মতো হচ্ছে না। 

ফয়সাল হাবিব নামে এক চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী বলেন, পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসে বুঝেছি। দক্ষতা না থাকলে শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে কাজ হয় না। বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলতে হয় এখন আমাদের। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের কোর্স কারিকুলামে সে অনুপাতে আপডেট করা হচ্ছে না। যুগের চাহিদা মাথায় নিয়ে কতোজন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার সংস্কারে কাজ করে যাচ্ছেন বলেও প্রশ্ন করেন তিনি। 

মাস্টার্স শেষ করা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি কর্মসংস্থান না বাড়ে তাহলে তো দেশ সংকটে পড়বেই। এখন কর্মসংস্থান করার মতো যদি কোনো কোম্পানি কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগের অভাব দেখা দেয়, তাহলে সরকারিভাবে কর্মসংস্থান করার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে বলা যায়, যে ধরনের কাজ করে একটা কোম্পানি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, সেসব কাজের উদ্যোগ নিবে সরকার। সরকার প্রোডাকশন ফ্যাক্টরির ব্যবস্থা করবে এবং সরকার দেশের বাহিরে কিংবা দেশের ভেতর উৎপাদিত সেসব পণ্য বিক্রি করবে। এতে দেশের বেকারত্ব কমবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, আর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে।

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম মানবজমিনকে বলেন, পিএসসিকে না জানিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আমরা কোন কোন পরীক্ষাগুলো আগে হয়েছিল তার একটি লিস্ট বানিয়েছি। লিস্ট ধরে ধরে আগের পরীক্ষার রেজাল্ট আগে দিতে হবে। এভাবে কাজ করে যাচ্ছি। লোকবলের সংকট রয়েছে পিএসসিতে। অনেক গোপনীয়তা নিয়ে এখানে কাজ করতে হয়। চাইলেই বাইরে থেকে কাউকে এনে কাজে লাগিয়ে দেয়া যায় না। সরকারি চাকরি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা শিক্ষার্থীদের হতাশার একটি কারণ সেটা অস্বীকার করা যায় না। চাকরি ঝুলে থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগাতে পারেন না। মন্ত্রণালয় ও পিএসসি সকলের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে পরীক্ষা নেয়া ও রেজাল্ট তৈরি করতে হবে। পরীক্ষা নিতে দেরি হওয়া, রেজাল্ট হতে অনেক সময় নেয়া এটার একটা নেতিবাচক প্রভাব থেকে যায়। এর কারণে দেখা যায় অনেকেই বাইরে চলে যান। 
তিনি আরও বলেন, সরকারি চাকরিতে জব ক্রিয়েশনের একটা বিষয়। যেটা বেসরকারি চাকরির মতো নয়। চাকরি দিতে না পারলে ছাত্ররা হতাশায় ভুগছে। এটার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এজন্য পদ সৃজন করা, যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে। সরকারি সেক্টরগুলোতে চাইলে পদ সৃষ্টি করা যায় না। নিয়ম মেনে করতে হয় সবকিছু। তবে অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছেন। বেকারত্ব ও বৈষম্য নিরসনে আমাদের আরও ফোকাস করা উচিত বলেও জানান তিনি। 

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রকিব উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, দেশের বাইরে মেধাবীরা যাচ্ছেন। তবে গেলে আর আসতে হবে না এই টেন্ডেন্সিটাও বেশি। কারিগরি শিক্ষার্থীদের দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ- সুবিধা অনেক বেশি। প্রযুক্তিগত দিক থেকে হাতে কলমে শিক্ষা নিয়ে গড়ে ওঠেন কারিগরি শিক্ষার্থীরা। একজন জুনিয়র তখন তার প্রতিষ্ঠানের কোনো সিনিয়রকে দেখেন বেকার। তখন মনে ধারণা জন্মে থাক আমিও আর চেষ্টা না করি তার থেকে ভালো দেশের বাইরে চলে যাই। পলিটেকনিকগুলোতে দক্ষ শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। 
তিনি আরও বলেন, চাকরির বাজারে পদ সৃষ্টি করতে হবে। উক্ত পোস্টের জন্য উপযুক্ত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। সবাইকে সরকারি চাকরি দেয়া সম্ভব হবে না। বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের চাহিদামতো আমরা দক্ষ কর্মী সরবরাহ করতে পারছি না। কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ বছর আমাদের সিলেবাস একই রকম থাকে। কিন্তু শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিয়ত টেকনোলজির আপডেট হচ্ছে। ফলে সেখানে খাপ খাওয়াতে অনেকেই সক্ষম হয় না। নতুন একটি মেশিন বাজারে আসলে আমাদের সিলেবাস পরিবর্তন করতে করতে সময় লেগে যায়। কারিগরি শিক্ষার্থীদের দক্ষ করার জন্য আমি সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। পলিটেকনিকসহ কারিগরির শিক্ষার্থীদের যাতে তারা ইন্টার্ন কাজ শেখার সুযোগ করে দেন। কারিগরি শিক্ষা সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে থাকে। তবে এআই প্রযুক্তি আমাদের দেশে কতোটা ফলপ্রসূ হবে। কতোটা কাজে কীভাবে দিতে হবে সেটা নিয়ে আমাদের গবেষণা হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং যাতে সুষ্ঠুভাবে আমরা দিতে পারি সেজন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। কর্মসংস্থানের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটা দূর হবে যদি আমরা এটা সম্পন্ন করতে পারি। কারিকুলামের বিষয়টি নিয়েও ভাবা হচ্ছে। ৬৫৪টি প্রতিষ্ঠানে প্রি-ভোকেশনাল চালু হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে এটার কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে দেখা যাবে শিক্ষার্থীরা শুরু থেকে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। নতুন কর্মসংস্থানে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। দ্রুত পেশায় যুক্ত করার জন্যই কারিগরি শিক্ষার কার্যক্রম করে থাকেন। সরকারি চাকরি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করার বিষয় না। কিন্তু একটা প্লানিং থাকাটা জরুরি। সবাই সরকারি সেক্টরে যেতে পারবেন না। এজন্য উদ্যোক্তা হতে হবে আমাদের। টেকনোলজির বিষয়ে দক্ষ হলে উদ্যোক্তা হিসেবে আরও ভালো কাজ করা যাবে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কারিকুলামে পরিবর্তন আনার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের কার্যক্রম নিয়েও আমরা ভেবে কাজ করি। সিভিল কার্যক্রমে এআইকে যুক্ত করার বিষয়টি গবেষণা হয়েছে। সামনে বাকি কোর্সগুলোতে রাখার বিষয়ে গবেষণা সেলে গবেষণার কাজ চলছে। 

বিনিয়োগে অগ্রগতি কম: অর্থনীতিবিদদের মতে, গত এক বছরে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। উল্লেখযোগ্য হারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়ায় শিল্পখাতসহ অনেক খাতেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ ছাড়াও কমেছে বিনিয়োগের হার, যুক্ত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা। যা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজারে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দেশে বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, উচ্চ সুদহার এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ অবস্থায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে কর্মসংস্থানের সংকট আরও বাড়ছে। 

তিনি আরও বলেন, বেকারত্ব কমাতে হলে একমাত্র পথ হলো ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। বরং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনশৃঙ্খলা থাকতে হবে। কোনোটাই বর্তমানে নেই। বিনিয়োগের জন্য দেশের নিজস্ব সঞ্চয় দরকার।

কৃষি-শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব: বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, তিনটি প্রধান খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি খাত। এক বছরের ব্যবধানে কৃষি খাতে ১৫ লাখ ৭০ হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছে। বর্তমানে এ খাতে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার। শিল্প খাতেও কাজ হারানোর হার উল্লেখযোগ্য। এক বছরে শিল্প খাতে ৭ লাখ ৬০ হাজার কর্মী কাজ হারিয়ে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৩ লাখ ৪০ হাজারে। এক বছর আগের তুলনায় এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২১ লাখ।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, একটা দেশের বিনিয়োগের জন্য শতকরা ৯৬ শতাংশ দেশীয় সম্পদ থেকে আসতে হয়। সঞ্চয় কমে গেলে বিনিয়োগ বাড়ে না। আইএমএফ’এর প্রেসক্রিপশনে সংকুচিত মুদ্রানীতি অনুসরণ করলে টাকার সরবরাহ কমে যাবে। ফলে বিনিয়োগ বাড়বে না। সুদের হার বেড়ে যাবে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। যা শ্রমবাজারে দীর্ঘমেয়াদি সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

ডলার সংকট: ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক মুদ্রার মূল্য ওঠানামাও শ্রমবাজারের সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। গত দুই বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, যা বর্তমানে সরকারি হিসাবে ১২২ টাকা। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে মুনাফা প্রত্যাহার করতে পারছেন না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ডলারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি।

এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, যত বেশি উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থানও তত বৃদ্ধি পাবে। গত এক বছরে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বিনিয়োগ বাড়ালেই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, আর বেকারত্বের হার কমবে।
দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্বের সংকট: দেশে প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান পায়, বাকিরা বিদেশে যায়। কিন্তু গত দুই দশকে বেকারের সংখ্যা ২৪ থেকে ২৮ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবিলম্বে কার্যকর নীতি গ্রহণ ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি না করলে বেকারত্বের হার আরও বাড়বে। 

দেশে আগামীতে সংকট তৈরি হতে পারে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংকট এখনো রয়েছে। বিগত সরকারের সময় থেকে সংকট শুরু হয়েছে। এই সংকট এখনো কমছে না বরং আরও বাড়ছে। বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিল্প খাতের দিকে মনোযোগ না দিলে বেকারত্বের সংকট দিনদিন বৃদ্ধি পাবে। ব্যবসা ও শিল্পখাতে বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব না।

রাজনৈতিক অস্থিরতা: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকেই দেশে সংকট  তৈরি হয়েছে। শিল্পখাতের অস্থিরতা ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। একের পর এক দেশে শিল্প কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের এমন সংকট সবসময় দেশকে বড় বিপদের সম্মুখীন করে তোলে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শিল্প খাতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক অস্থিরতা যার সম্ভাবনাকে শেষ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকায় সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা শিল্পখাতে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত পড়ে। দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। তাদের বড় একটা অংশ তরুণ যুবক। শিল্প খাতে বিনিয়োগ ব্যতীত নতুন কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব না বলেও মনে করেন তারা। বিনিয়োগের পূর্ব শর্ত হলো স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা।

 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status