শেষের পাতা
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন
অতীতকে বিশুদ্ধ করছে বাংলাদেশ
মানবজমিন ডেস্ক
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবারদীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। শত অন্যায় জুলুমকে মোকাবিলা করতে এ দেশের ছাত্ররা বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের জুলাইতে একটি সফল অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয় ছাত্ররা। ক্রমান্বয়ে আন্দোলনে দেশের সকল ছাত্র-জনতা অংশগ্রহণ করলেও এর সূচনা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারাই আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ‘মুজিবীয়’ চিন্তার মাধ্যমে বাংলাদেশে যে ফ্যাসিবাদী শাসন গড়ে উঠেছিল তা জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে বলে দাবি ছাত্রনেতাদের। এখন বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিশুদ্ধ করার কথা জানিয়েছেন তারা।
‘উই আর ট্রাইং টু মেক হিস্টরি রাইট’: বাংলাদেশ রিরাইট ইটস পাস্ট- শিরোনামে সোমবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বৃটেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)- যেখান থেকেই আগস্টে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাতের আন্দোলন শুরু হয়। হাসিনাকে উৎখাতের পর তার প্রয়াত পিতা স্বাধীনতার নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের একটি দেয়ালচিত্রকে বিকৃত করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। শেখ মুজিবকে অনেকে জাতির পিতা হিসেবে শ্রদ্ধা করলেও তার ছবিতে লাল রং মেখে দিয়েছে তারা। কেউ একজন ছবিটির ওপর ‘ফ্যাসিবাদের প্রতীক’ শব্দটি খোদাই করে লিখে দিয়েছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে উৎখাতের মাত্র ছয় মাস পার হয়েছে। এর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস পুনর্লিখন শুরু করেছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের ভূমিকার বিষয় কমিয়ে আনা হয়েছে যা তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
আন্দোলনে অংশ নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র মোহাম্মদ আবু বাকের বলেছেন, আমরা পুরো বিষয়টি পুনর্লিখনের চেষ্টা করছি না, তবে স্পষ্টতই কিছু বিষয় রয়েছে যার পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন- গল্প, কবিতা এবং শিল্পকর্মের মাধ্যমে একটি মুজিববাদী আদর্শ তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ। আমরা শুধু সেটিকে বিশুদ্ধ করার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই জাতীয় আখ্যানের ওপর ঐকমত্য অর্জন করা। কেননা, এটি ছাত্র নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক যুগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার যে আকাঙ্ক্ষা রয়েছে সেটির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। দেশের ঐতিহ্যবাহী বিরোধী রাজনৈতিক শিবির- শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে নিজেদের বৈধতা অর্জন করে। ইতিহাস পুনর্লিখনের পাশাপাশি দেশের বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম এবং পুলিশের জন্য ব্যাপক সংস্কারে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দাবি, ‘ফ্যাসিবাদী’ আওয়ামী লীগের দমনমূলক শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানসমূহকে দখল করা হয়েছে।
পাঠ্যপুস্তকে মুজিবকে এককভাবে জাতির পিতার মর্যাদা থেকে অবনমিত করা হয়েছে। এসব সংস্কারের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধিরাও কাজ করছেন। একসময় পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদে তার ছবি এবং উক্তি ব্যবহার করা হতো। এখন সেগুলোর পরিবর্তে হাসিনাকে উৎখাতের সময় প্রদর্শিত গ্রাফিতিগুলো সংযোজন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ মুজিবের ম্যুরাল এবং ‘মুজিব কর্নার’ ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে ছাত্র-জনতা। এ ছাড়া মুজিবের ধানমণ্ডি ৩২ এর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
তবে দেশকে পুনর্গঠনের এই প্রচেষ্টায় ব্যাপকভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এসব বাধার মধ্যে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপ। দেশে এবং ভারতে ড. ইউনূসের সমালোচকরা অভিযোগ করেন যে, তার ছাত্র উপদেষ্টারা বিপজ্জনক ‘মৌলবাদী’ এবং ইসলামপন্থিদের প্রতি বেশ কোমল।
হাসিনার আমলের সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূস বারবার বলতে চান যে, তিনি রিসেট বোতাম টিপতে চান। যা তিনি ইতিহাস বিকৃত করে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যাচারের মাধ্যমে করে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তাই তারা শেখ মুজিবকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি, তারা তাকে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে রেখেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি- পরবর্তী নির্বাচনে জয় পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারাও ইতিহাস পুনর্বিবেচনার কাজটিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। বর্তমানে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন জিয়ার পুত্র তারেক রহমান।
পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর একটি হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আগের সংস্করণগুলোতে মুক্তিযুদ্ধকে শেখ মুজিবের ভূমিকার ওপর নিবদ্ধ থাকলেও ২০২৫ সালের সংস্করণে জিয়াউর রহমানের চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাকে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এটি স্পষ্ট করা হয়েছে যে, তিনি মুজিবের পক্ষেই তা করেছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, আমার নির্দেশিকা ছিল- আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র তৈরি করা বয়ান দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না। কেননা, সংস্কারের কাজকে ‘সুযোগের জানালা’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা হয়েছে। এ বিষয়টি নয়াদিল্লির নজর কাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। আগের সংস্করণগুলোতে ভারতের অবদানের কথা ব্যাপকভাবে উল্লেখ করা হলেও বর্তমান সংস্করণগুলোতে নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের শেষের দিকে ভারতের অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করা হয়েছে। আগের পাঠ্যপুস্তকে ভারতের সামরিক সহায়তা, যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। বর্তমানে এসব বিবরণ অনুপস্থিত। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীদের আলোচনাও কমিয়ে আনা হয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের কেন্দ্রীয় ভূমিকার পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল সে বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া সামপ্রতিক নানা ঘটনাবলীও সামনে আনা হয়েছে, যার মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ শেখ হাসিনার অধীনে জোরপূর্বক গুমের বিভিন্ন ঘটনাও রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনির বলেছেন, বাংলাদেশের তরুণরা বলে ‘আপনাকে ১৯৭১ সালের সঙ্গে ২০২৪ সালের দিকেও তাকাতে হবে। ১৯৭১ কেবল একজন ব্যক্তির নয়।’ বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এখন নারী-নেতৃত্বাধীন সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর কথাও রয়েছে। জোরপূর্বক গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এবং নিখোঁজদের সন্ধান এবং দায়ীদের বিচারের দাবিতে ২০১৪ সালে এই সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল।
বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘গত ১৫ বছরে যা ঘটেছে...এখন তা প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন জোরপূর্বক গুম, গোপন নির্যাতন কক্ষ, হত্যা করে মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেয়া। এখন মানুষ সেই গল্পগুলো আবিষ্কার করছে।’