শেষের পাতা
দাভোসে ড. ইউনূসের ব্যস্ত সময়
গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংস্কার ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা
স্টাফ রিপোর্টার
২৩ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবারসুইজারল্যান্ডের দাভোসে ব্যস্ত সময় পার করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে যোগ দিতে সোমবার তিনি দেশটির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। দাভোসে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একাধিক সাইডলাইন বৈঠক করেন তিনি। এ ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠক ও সাক্ষাৎ করা নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি, মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের চেয়ারম্যান ক্রিস্টোফ হিউসজেন, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার স্টাব, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতাংতার্ন সিনাওয়াত্রা, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস-হোর্তা, বেলজিয়ামের রাজাম ফিলিপ, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্ড, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁ, দুবাই কালচারাল ও আর্ট অথরিটির চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, জার্মানির ফেডারেল চ্যান্সেলরির প্রধান উলফগ্যাং স্মিডট। আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংস্কার, রোহিঙ্গা সংকটসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। এ ছাড়াও বৈঠকে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠন ও জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন ও বিশ্ব সরকার সামিটে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং একাধিক বার্তায় এসব তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে সম্মেলনের সাইড লাইনে আসিয়ানের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য জার্মান সরকার সর্বাত্মক সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ। দাভোস শহরে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এমনটাই জানান তিনি। তিনি ছয়টি কমিশনের দাখিল করা সংস্কার প্রতিবেদনগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করছেন। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে, রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে, যা জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের গণতান্ত্রিক চেতনা বজায় রাখবে। এ ছাড়া, দুই নেতা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। যার মধ্যে ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক, রোহিঙ্গা সংকট এবং মিয়ানমারের নিরাপত্তা পরিস্থিতি। কীভাবে তরুণরা দুর্নীতিপূর্ণ শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য জুলাই অভ্যুত্থানে যোগ দিয়েছিল তা জার্মান চ্যান্সেলরকে ব্যাখ্যা করেন প্রধান উপদেষ্টা। একজন ১২ বছর বয়সী ছাত্র অভ্যুত্থানে যোগদানের আগে তার মায়ের কাছে একটি চিঠি লিখে শহীদ হন, এই ঘটনা প্রধান উপদেষ্টা শুলজকে জানান। ড. ইউনূস দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদার করার আহ্বান জানান এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখার জন্য একটি জার্মান ব্যবসায়ী দলকে ঢাকায় পাঠানোর অনুরোধ জানান। এ সময় তিনি বাংলাদেশে আরও জার্মান বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানান। ড. ইউনূস জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরিতে শুলজের সহযোগিতা কামনা করেন।
এদিকে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে বাংলাদেশকে সমর্থন করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি এই কথা বলেন। রোহিঙ্গা সংকটের জন্য, বিশেষ করে চলতি বছরের শেষের দিকে এই বিষয়ে একটি বড় বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা সমর্থন চাওয়ার পর গ্র্যান্ডি বলেন, আমরা আপনাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আপনার কথায় আরও গুরুত্ব বাড়াবে। তিনি রোহিঙ্গা সংকটের ওপর বিশ্বের মনোযোগ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান। বলেন, প্রায় ১ লাখ শরণার্থীর আগমন বাংলাদেশের ওপর আরও বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে যখন তারা (মিয়ানমার) আরও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল নির্মাণে উন্নত উপকরণ ব্যবহার করার অনুমতি দেয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান। পূর্বে, রোহিঙ্গাদের কেবল বাঁশ এবং ত্রিপল দিয়ে আশ্রয় তৈরি করার অনুমতি ছিল। বৈঠকে তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানবিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন। যেখানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি লড়াই করছে।
প্রধান উপদেষ্টা গ্র্যান্ডিকে জানান যে, তিনি রোহিঙ্গা সংকটের জন্য একজন উচ্চ প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন এবং যিনি সব সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করছেন।
ওদিকে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফ হিউসজেনও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির মিউনিখ শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বার্ষিক নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান। সাক্ষাৎকালে তারা জুলাই বিপ্লব, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, রোহিঙ্গা সংকট এবং অনলাইনে ভুয়া তথ্য প্রচারের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। রাষ্ট্রদূত হিউসজেন বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুয়া খবর ও অপ-তথ্য প্রচারের জন্য ফেসবুকের মতো অনলাইন প্ল্যাটফরমকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি পরামর্শ দেন- বাংলাদেশ ইউরোপীয় দেশগুলোর উদাহরণ অনুসরণ করে অনলাইন প্ল্যাটফরমের কনটেন্ট যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করতে পারে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়াও ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার স্টাব বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে গ্লোবাল সাউথের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা এবং রোহিঙ্গা সংকটসহ গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের এমন পৃথিবী দরকার যা হবে আইনের শাসনভিত্তিক। প্রফেসর ড. ইউনূস ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টকে অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করেন। আলেক্সান্ডার স্টাব বলেন, আমি আপনাদের জন্য শুভকামনা জানাই। প্রেসিডেন্ট স্টাব গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ লুটপাট ও দুর্নীতি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস জানান, তার সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করবে, যার মাধ্যমে শরণার্থীদের দুর্দশা আবারো বৈশ্বিক আলোচনায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
এদিকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব সরকার সামিটে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দুবাই কালচারাল অ্যান্ড আর্টস অথরিটির চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম। চলতি বছরের ১১ থেকে ১৩ই ফেব্রুয়ারি সামিটটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এ সময় লতিফা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকারে স্থান পাওয়া তিন উপদেষ্টাকেও আমন্ত্রণ জানান। যাতে তারা বর্ণনা করতে পারেন কীভাবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তাদের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এ সময় তারা উভয়ে আগামী দিনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের সম্ভাবনার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই’।