মত-মতান্তর
বেশি দরকার রাজনীতির ‘চরিত্র’ বদলে দেয়া
ড. তারেক ফজল
২২ জানুয়ারি ২০২৫, বুধবার
আমার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের বলছিলাম, তোমরা রাষ্ট্রীয় সংবিধান বদলে দেয়ার একটা প্রক্রিয়ার সাক্ষী হতে পারছো। এটা বেশ অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ‘বানাবার কালে’ আমার অংশীদার হওয়ার সুযোগ ছিল না। এবার আমার উৎসাহে তোমাদের কয়েকজন রিপাবলিক থেকে ‘প্রজা’ সরিয়ে দেয়ার প্রচারে অংশীদার হতে পেরেছো। একদা এটা তোমাদের ভালো স্মৃতি হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের চলমান প্রক্রিয়ায় আমরা কেউ কেউ অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করছি, এটা-ওটা প্রস্তাব করছি। পাঠকদের কেউ কেউ স্পষ্ট উচ্চারণেই বলছেন, এসব বদলানোর চাইতে রাজনীতিকদের বদলানো বেশি দরকার। কথাটা ফেলনা নয়। রাজনীতিকদের বদলাতে হবে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে এবং তাদের ভেতর থেকে বদলে দেয়ার জন্য মৌলিক ও ভিন্ন প্রস্তাবও করতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির একজন নগণ্য পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়, বিদ্যমান বাংলাদেশি রাজনীতির আংশিক মৌলিক চরিত্র বদলে দিতে পারে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং তা হলো, বাংলাদেশের জাতীয় আইন প্রণয়নকারী হিসেবে যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন, তারা পুরোপুরি স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন ও থাকবেন। স্থানীয় পর্যায়ের, মানে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যদি অংশ নেয়ার সুযোগ রহিত হয়, আমার অনুমান, ব্যবসায়ী রাজনীতিকসহ প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ রাজনীতিক রাজনীতি থেকে বিদায় নেবেন। কেন বিদায় নেবেন? বিদায় নেবেন, কারণ এই স্থানীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়াতে রাজনীতি করার ‘মূল মধু’ লুকিয়ে আছে। আসলে ‘লুকিয়ে’ নেই, একেবারে ‘প্রকাশ্যেই’ আছে সেই মধু। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার এটি এক উল্লেখযোগ্য সূত্র।
আইনসভার সদস্যরা রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নের কাজেই প্রধানত মনোযোগী থাকবেন। আর মনোযোগ দেবেন সরকারের নির্বাহী বিভাগকে সঠিকভাবে নির্দেশনা দেয়ার কাজে। নির্বাহী বিভাগকে আইনসভা উপযুক্ত ও ঘোষিত প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ করবে। তাতে ভোটার জনগণের নিয়মিত বস্তুগত জীবন সহজ ও আনন্দের হয়ে উঠবে।
প্রশ্ন আসবে, তবে স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কারা থাকবেন? জবাবটা রাজনৈতিক তত্ত্বে স্পষ্ট করে দেয়া আছে। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য জনগণের ভোট অর্জন করেন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব। তাদেরই মূল কাজ যাবতীয় স্থানীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করা। জাতীয় আইনসভার সদস্যরা জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন নীতিমালা নির্ধারণে ভূমিকা রাখবেন, আইন বানাবেন, জাতিকে নেতৃত্ব দেবেন।
বাংলাদেশে তা হয় না, ভাবাও হয় না। কারণ এই মৌলিক নীতির বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি, এখনো। আমি আজই বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্বকে স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে এই সিদ্ধান্তটি নেয়ার উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানাই। এই একটি সিদ্ধান্ত রাজনীতি বদলে দেবে, বাংলাদেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য বদলে দেবে। বাংলাদেশ তাৎপর্যপূর্ণ সমৃদ্ধির পথে এগোতে থাকবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের প্রফেসর।