ঢাকা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, সোমবার, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

এক ভয়াল রাতে শাকিলের শেষ যাত্রা

ড. এ. কে. আজাদ
১৬ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবারmzamin

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব এবং ছাত্র-জনতার অবিশ্বাস্য বিজয়। বিজয়ের এ ধারা কখনো মসৃণ পথে পিচ্ছিল যাত্রা ছিল না। প্রায় ২ হাজার বনি আদমের শহীদ হওয়া, ৩০ হাজার মানুষের আহত ও অঙ্গহানির বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা।

সময়টা ছিল ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার। বিকালে ফেসবুক খুলতেই দেখি পারভেজের মৃত্যু সংবাদ। মো. শাকিল হোসেন পারভেজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রোগ্রামের আশুলিয়া ক্যাম্পাসে আমাদের ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে উত্তরায় পুলিশের গুলিতে শাহাদত বরণ করেন। কোনো মতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে শাকিলকে ফোন দিলাম, কিন্তু ফোনে  না পেয়ে আর একজন ছাত্রকে ফোন দিলাম এবং জানতে পারলাম ঘটনার সত্যতা। এরপর ভিসি স্যার, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ডিন, রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, কোর্ডিনেটরসহ আরও বেশ ক’জন সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ করলাম। মসজিদে মাগরিবের আজান চলছে, আজানের সঙ্গে মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের সামনে মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ, সঙ্গে মিছিলের উচ্চ আওয়াজ। আমজনতার ছোটাছুটি। কোনো মতে নফল রোজার ইফতার ও নামাজ শেষে স্ত্রী-সন্তানকে বললাম, আমি যাই। তোমরা আমার জন্য দোয়া করো। মহান আল্লাহর নাম নিয়ে বের হলাম। কিছুদূর হাঁটার পর একটা রিকশা নিয়ে শ্যামলী। চালক জানালো ভাই, ওদিকে মারামারি হচ্ছে, ‘আমি যাইয়াম না’।

আরও কিছুদূর হেঁটে, আর একটা রিকশা পেলাম, খুব অনুরোধ করে তিনগুণ ভাড়া দেয়ার শর্তে রাজি হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে শ্যামলীতে পৌঁছলাম। রাস্তায় পুলিশ-বিজিবি’র গাড়ি ও দু’ একটি রিকশা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। শ্যামলী থেকে সিএনজিতে মাজার রোড, সেখান থেকে আর একটা সিএনজিতে বিরুলীয়া ব্রিজ। বিরুলীয়া ব্রিজ থেকে অটোরিকশায় মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুলিয়া ক্যাম্পাস।

ফ্রিজ এম্বুলেন্সে আমার সদা হাস্যোজ্জ্বল শাকিলকে নীরবে ঘুমাতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আবার শক্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম এই ভেবে যে, আমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ি তবে ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা কী হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানাজা নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষে শাকিলের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো তামীরুল মিল্লাতের গাজীপুর ক্যাম্পাসে এবং সেখান থেকে টঙ্গী পূবাইল হয়ে তার জেলা লক্ষ্মীপুর।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও  ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মিলিত মিটিংয়ে তাদের দাবিগুলো লিখিত আকারে জমা দেয়। 
লাশের সঙ্গে কে যাবে এই ভয়াল রাতে, এই নিয়ে চলছিল বেশ আলোচনা। অনেকেই সেদিন রাতে যাওয়ার ব্যাপারে পিছপা হলেন। অনেকে পরের দিন যাওয়ার কথা বললেও বাস্তবে আর যাওয়া হয়নি। অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি সে রাতের ভয়াবহতায় জানাজা নামাজেও আসতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনায় রাত ১০টার দিকে আশুলিয়া ক্যাম্পাস থেকে আমার নেতৃত্বে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্রসহ দশ সদস্যের একটি টিম নিয়ে আমরা রওনা হলাম শাকিলের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। আবদুল্লাহপুর যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একদল লোক লাঠি দেখিয়ে আমাদের গাড়ি উল্টো ঘুরাতে বললো। গাড়ির চালক বাবুল ভাই বললো, কী করবো স্যার? ওরাতো গাড়ি ভেঙে ফেলতে পারে, গাড়ি জ্বালিয়েও দিতে পারে। আমি বললাম, বাবুল ভাই পেছনে ফেরার কোনো উপায় নাই। এখন ফড় ড়ৎ ফরব! সামনে এগিয়ে যেতে হবে। গাড়ি এগিয়ে গেল, আমরা পরিচয় দিলাম, কথা বললাম, ওরা আমাদের গাড়ির দরজা খুলে চেক করলো, লাইট মেরে আমাদের চেহারা দেখলো। তারপর যেতে দিলো। এভাবে বেশ কয়েকবার আমাদের গাড়ি চেকের  সম্মুখীন  হলাম। প্রতিবারই যখন হাতে লাঠি নিয়ে কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আমাদের গাড়ি থামিয়ে চেক করছিল তখন আমরা কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিলাম। কারণ অনেক  গাড়ি জ্বালিয়ে দিতে দেখেছি, অনেক মানুষকে হতাহত হতে দেখেছি, অনেক মানুষকে বন্দি করে  নিয়ে যেতে দেখেছি, নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু যতবারই আমরা ভয় পেয়েছি, আমার মনে হয়েছে শাকিল আমাকে বলছে, স্যার ভয় পাবেন না আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। মহান আল্লাহর অসীম কৃপায় আমার বারবার একথাই মনে হয়েছে। শাকিলের গাড়ি যখনই একটু পেছনে পড়ে যাচ্ছিল তখনই আমার ভয়, চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছিল, যে আমরা ঠিকমতো পৌঁছাতে পারবো তো? মনে হচ্ছিল শাকিল বারবার বলছে স্যার চিন্তিত হবেন না। আমি তো আছি! ফজরের আজানের শব্দ শুনলাম, মনে হলো শাকিল বলছে স্যার নামাজ পড়ে নিন। রাস্তার পাশে মসজিদ দেখে গাড়ি থামিয়ে আমরা ফজরের নামাজ পড়তে দাঁড়ালে আমার মনে হলো শাকিল কোথায়, শাকিল বললো আমার জন্য চিন্তা করবেন না আমি তো আপনাদের পেছনেই আছি। নামাজ শেষে আবার আমাদের যাত্রা শুরু। এরইমধ্যে শাকিলকে বহনকারী গাড়ির পেছনের বামপাশের দু’টি চাকাই পাংচার হলো। আমি ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। মহান রাব্বুল আলামীনের সাহায্য চাইলাম, মনে হলো পথিমধ্যে এক বাজারের গাড়ি মেকানিকের কাছে থামিয়ে চাকা পরিবর্তন করার চেষ্টা করলো কিন্তু এই বৈরী পরিবেশে ব্যবসায়ী তার দোকান খুলতে চাইলো না। গাড়ির অতিরিক্ত চাকাটিও ভালো ছিল না।

অনেক কষ্ট করে পুরোনো চাকাটি লাগিয়ে কোনো মতে আমরা সকাল ৯টার দিকে শহীদ শাকিলের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানার ১নং উত্তর হামসাদী ইউনিয়নের, কাফিলাতলি, ১নং ওয়ার্ডের আমানুল্লাহ মিয়াজি বাড়ি পৌঁছালাম। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই শত শত মানুষের প্রতিবাদী মিছিলে গ্রামের বন-বনানী কেঁপে উঠছিল। শাকিলকে একনজর দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। সকাল ১০টায় স্থানীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার নামাজে জানাজার ব্যবস্থা করা হলো। অত্র এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আলোচনা করলেন, শাকিলের শিক্ষক হিসেবে আমাকেও কিছু বলার সুযোগ দিলো। আমি বলেছি, শাকিলের মতো আদর্শবান তরুণের আত্মত্যাগ কখনই বৃথা যাবে না। জানাজা শেষে শাকিলের লাশ কাঁধে করে কবরস্থানের দিকে যাচ্ছিলাম, আর মনে হচ্ছিল শাকিল বলছে, স্যার! আপনারা আমার জন্য এত কষ্ট করছেন। শাকিলকে কবরে নামানোর দৃশ্য দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। দু’চোখ দিয়ে অঝোরে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছিল। মনে হচ্ছিল ওই মায়াবি হাসি দিয়ে শাকিল কি আমার সঙ্গে  এসে আর কথা বলবে না? শাকিলকে মাটি দিয়ে যখন ঢেকে দেয়া হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, শাকিল বলছে, স্যার, চিন্তা করবেন না একদিন দেখা হবে সবার সঙ্গে জান্নাতে। শাকিলকে দাফন করার পর দোয়া করার দায়িত্ব আসে আমার ওপর। শাকিলের জন্য ও শাকিলের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রাণভরে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, সকলের জন্য, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য, সর্বোপরি বাংলাদেশের শান্তি আর সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করলাম। উল্লেখ্য যে, শাকিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও তার পরিবার অনেকটাই অসচ্ছল। তাদের গ্রামে কোনো ঘর নেই, ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকে। শাকিল টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালাতো, সঙ্গে পরিবারকেও সাহায্য করতো। মা শারবিন আক্তার দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইজড, শাকিল মাকে রান্না করে নিজ হাতে খাইয়ে দিতো। তিন বোনের একমাত্র ভাই শাকিল হোসেন। বড় বোন-বিউটি আক্তার, মেজো বোন- সুইটি আক্তার আর ছোট বোন নাদিয়া আক্তার। বোনরা সবাই বিবাহিত ও বোনদের জামাইরা ছোটখাটো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বাবা মো. বেলায়েত হোসেন খুদে ব্যবসায়ী। জানাজা নামাজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সাময়িকভাবে দেয়া আর্থিক অনুদান শাকিলের বাবার হাতে তুলে দিয়েছি আর জড়িয়ে ধরে বলেছি শাকিলের মতো সন্তানের বাবা হয়ে আপনি ধন্য। শাকিল আপনাদের জান্নাতের পথ সুগম করে দিয়েছে। শাকিলের মতো ছাত্র আমাদের জন্য গর্ব। মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র দেশের মানুষ আপনাদের সঙ্গে সবসময় থাকবে ইনশাআল্লাহ্। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী তাদের একদিনের বেতন শাকিলের পরিবার ও আহতদের জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা দেশ-বিদেশ থেকে শাকিলের পরিবারে পাশে দাঁড়াতে পারেন।    

আমাদের যাত্রা পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকে ফোন করে আমাদের অবস্থার খবর নিয়েছেন। সারা রাত এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাইনি। 
বলা যায় সার্বক্ষণিক বিভিন্ন দোয়া ও কোরআন তিলাওয়াত করার চেষ্টা করেছি। দাফন শেষেই আমরা ঢাকায় রওনা হই। আশিকুন্নবী স্যার, আব্দুল আলী ভাই, চালক বাবুল ভাইসহ সকল ছাত্র যারা আমার সঙ্গে গিয়েছেন এবং সার্বিক সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও দোয়া। আল্লাহ্ সকলকে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা দান করুন। শাকিলকে রেখে ঢাকায় ফেরার বাস্তবতা না হয় আর একদিন লিখবো।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

পাঠকের মতামত

আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুন! আমীন!

AbuTaher
১৭ জানুয়ারি ২০২৫, শুক্রবার, ৪:৪৯ অপরাহ্ন

দোয়া করি আল্লাহপাক যেন সব সময় আপনাকে ন্যায় ও সত্যের পথে চলার তৌফিক দেন। আল্লাহ্ সকলকে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা দান করুন । সর্বোপরি বাংলাদেশের শান্তি আর সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করি

সৌরভ
১৬ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১২:৪০ অপরাহ্ন

সম্পূর্ণ সংস্কারের পর নির্বাচন করতে হবে। সবার আগে বিচার করতে হবে যারা প্রশাসনে থেকে গত ১৫ বছর হাসিনাকে খমতায় রাখার জন্য নির্বাচন নামে প্রহসন করেছে, তাদের।

সোহাগ
১৬ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন

হৃদয়গ্রাহী লিখনী স্যার - দোয়া করি আল্লাহপাক যেন সব সময় আপনাকে ন্যায় ও সত্যের পথে চলার তৌফিক দেন।

জনতার আদালত
১৬ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৭:০৫ পূর্বাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status