শেষের পাতা
বদলি-পদায়ন-পদোন্নতিতে ব্যস্ত পুলিশ, মাঠের নিয়ন্ত্রণ ফিরেনি
শুভ্র দেব
১৩ জানুয়ারি ২০২৫, সোমবার
চেষ্টা থাকলেও মাঠ পর্যায়ে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ফিরছে না। কর্মকর্তাদের অনেকে বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছেন না। কেউ কেউ আগের ধারায়ই অধস্তনদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ কারণে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সারা দেশে। ব্যক্তিগত ক্ষোভ, দ্বন্দ্ব, পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ ফায়দা নেয়ার জন্য অনেক নিরীহ মানুষকে দিয়ে পুলিশ ও কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি মামলা বাণিজ্য শুরু করেছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার খবর আসছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা হচ্ছে, আসামি ধরা পড়ছে। কিন্তু দেশের অপরাধ প্রবণতা কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান মতে প্রতি সপ্তাহ ও মাসে অপরাধ বাড়ছে। বেপরোয়া হচ্ছে অপরাধীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ৫ই আগস্টের পর থেকে পুলিশ মনোবল হারিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ থেকে কার্যত দূরে থাকলেও বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি নিয়ে তাদের আগ্রহের কমতি নাই। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমলে পুলিশের যেসব কর্মকর্তা সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত ছিলেন, বাহিনীর অগুরুত্বপূর্ণ ও ডাম্পিং পোস্টে চাকরি করে বছরের পর বছর পার করেছেন তারাই এখন সামনে এসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সিন্ডিকেট তৈরি করে নিজেদের বলয়ের কর্মকর্তাদেরও ভালো ভালো স্থানে বদলি পদায়ন করছেন। দীর্ঘদিন যারা পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন তাদের পদোন্নতির জন্য কাজ করছেন। সরকার পতনের পর থেকে লাগাতার যে বদলি পদায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেটি ৫ মাস পরেও অব্যাহত আছে। বিশেষকরে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কিছুদিন পরপরই রদবদল হচ্ছে। কোনো কর্মকর্তাই তার কর্মস্থলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, অপরাধ, অপরাধীদের সম্পর্কে বুঝে ওঠার আগেই আবার নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে হচ্ছে। আইজিপি থেকে শুরু করে পুলিশের সবক’টি ইউনিট প্রধান, মেট্রোপলিটন কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপার, থানার ওসি, এসআই, এএসআই কনস্টেবল পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের বদলি করা হচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের অপরাধী, জঙ্গি, মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী, জলদস্যু, ডাকাত, নারী নির্যাতনকারী, চাঁদাবাজ, মানব পাচারকারী, অপহরণকারীসহ বিভিন্ন অপরাধীরা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশে সংস্কার আনার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। সংস্কার কমিশনও বেশ পরিবর্তন নিয়ে আসছে পুলিশ বাহিনীতে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশ কার্যকরী হলে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতা কমে যাবে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতা বেড়ে যাবে। কমিশন সুপারিশগুলো সরকার আমলে নিয়ে যদি বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়া হলে বাহিনী সেটি কীভাবে নিবে। মাঠ পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কতোটুকু ভূমিকা রাখবে সেটিও বড় প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশে যেভাবে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে সেটি খুবই উদ্বেগের। মাঠ পর্যায়ে পুলিশের তৎপরতা একেবারে কমে গেছে। আগের মতো টহল দেয় না পুলিশ। যেসব এলাকায় টহল হয় সেগুলো নামমাত্র। আসামি ধরার ক্ষেত্রেও পুলিশের অনাগ্রহ রয়েছে। এ ছাড়া দেশ জুড়ে এত অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পরও পুলিশ কঠোর কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রও পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এসব অস্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে চরমপন্থি, দাগি আসামি, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, ছিনতাকারীসহ অন্য অপরাধীদের কাছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ খুনসহ চাঁদাবাজি, ছিনতাই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, অপরাধীদের আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রক্রিয়া আমাদের যথেষ্ট দুর্বল। দুর্বল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো পদক্ষেপকেই তারা তোয়াক্কা করছে না। তারা মনে করছে মামলা করে গ্রেপ্তার করে তাদেরকে কারাগারে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে আবার অপরাধ করা যাবে। তাই অপরাধীরা কারাগারে থাকুক আর বাইরে থাকুক অপরাধ সমানতালে করবে। প্রচলিত আইনের মাধ্যমে আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারছি না। শাস্তি নিশ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মামলা তদন্ত, পুলিশের জোরালো ভূমিকা, অপরাধীদের ক্ষেত্রে সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও অপরাধীদের আইনের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে তাদের যে অঙ্গীকারের মতো জায়গাগুলোতে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। এ ধরনের ঘাটতি থাকলে কোনো অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক মানবজমিনকে বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকায় আমাদের প্রতিটি টিম রাতদিন কাজ করছে। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর অনেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। গোয়েন্দারা কাজ করছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ এখনো আগের কার্যক্রমে ফিরেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে ধরনের গতি থাকা দরকার তাদের কার্যক্রমের ভেতরে সেটি দেখা যাচ্ছে না। যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মানবজমিনকে বলেন, সার্বিকভাবে সারা দেশের যে অপরাধপ্রবণতা সেটি ৫ই আগস্টের পর আমাদের সংহত না হওয়াসহ নানা কারণেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা আমরা পুরোপুরি সংহত না হওয়া পর্যন্ত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। এটাই আমরা চেষ্টা করছি যাতে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারি। অপরাধের পরিসংখ্যান কী বলে সেটা দেখতে হবে, তবে আপাতত দৃষ্টিতে অপরাধ বাড়ছে সেটা সঠিক। কারণ ঢাকায়ও বেশ কিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। অপরাধীরা মনে করছে পুলিশ এখনো আগের মতো সেটেল হতে পারেনি। তাই কিছু অপরাধ করে ফেলি। তিনি বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের এখন নতুন কোনো পদ্ধতি নেই। গতানুগতিকভাবে যেটা করি সেটাই করছি। কারণ পুলিশ বাহিনী এখনো আগের পর্যায়ে নাই। সঠিক অফিসারকে সঠিক জায়গায় দিতে পারিনি এবং তারা সেভাবেই কাজ করবে এই অবস্থাটা এখনো হয়নি। এরপরে ২৮শে ডিসেম্বর আইজিপি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের হাতে ম্যাজিক নেই।