ঢাকা, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২ রজব ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

রোহিঙ্গা গণহত্যা রোধে প্রতিবেশী দেশগুলোর দায়িত্ব

এ জি এম নিয়াজ উদ্দিন

(১ সপ্তাহ আগে) ১১ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবার, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৭ পূর্বাহ্ন

mzamin

চট্টগ্রামের পাশে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিশাল উদ্বাস্তু শিবিরকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্র। গণহত্যার শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মানুষগুলো দিন কাটাচ্ছে চরম অনিশ্চয়তায় এবং অমানবিক পরিস্থিতিতে। তাদের দুর্গতি দেখে মনে হয়, রোহিঙ্গারাও যে মানুষ তা যেন বিশ্ববাসী ভুলেই গেছে। আর রোহিঙ্গা গণহত্যায় প্রতিবেশী দেশগুলো যেন গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য যে গণহত্যা চলছে তা ফিলিস্তিনের গণহত্যার সঙ্গে তুলনীয়। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের জাতিবিদ্বেষী নীতির কারণে আরাকান তথা রাখাইনের স্থায়ী বাসিন্দা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গণহত্যার শিকার হয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশের আশ্রয় শিবিরে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করেও পাচ্ছে না মানবিক অধিকার ও আত্মপরিচিতি। বর্তমানে গৃহযুদ্ধের কারণে অকাতরে মারা যাচ্ছে আরাকানের অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আরাকান আরেক ফিলিস্তিনে পরিণত হলেও প্রতিবেশী দেশগুলো নিশ্চুপ। মিয়ানমারের প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর তরফে গণহত্যা বন্ধে আদৌ কোনও পদক্ষেপও লক্ষণীয় নয়।

তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন বছর ২০২৫ এর প্রথম ৯ দিনে ৪৯০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইতোমধ্যে দেশটিতে মোট মৃত্যু সংখ্যা দাড়িয়েছে ৪৬ হাজার। অন্যদিকে, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ন্ত্রিত রামরি টাউনশিপের কিয়ুকনিমাও গ্রামে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় শিশুসহ ৪০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। এ হামলায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিমান হামলায় কিয়ুকনিমাও অঞ্চলে অন্তত ২০ জন বাসিন্দা আহত হয়েছেন। এছাড়া উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় অন্তত ৫০০ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। আহতদের মধ্যে শিশু, নারী ও বয়স্করা রয়েছে। এগুলো হলো লাগাতার গণহত্যার অংশ বিশেষ মাত্র। এতে স্পষ্ট যে, আরাকান আর ফিলিস্তিন প্রকারান্তরে গণহত্যার অভিন্ন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক পর্যায়ে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়া চরম বেদনার বিষয়। এ কথা সত্য যে, আরাকানের গণহত্যা ও সশস্ত্র সংঘাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বাংলাদেশকে। সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ চলে এসেছে বাংলাদেশে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু মানুষ সংঘাত কবলিত মিয়ানমারের আরাকান থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসছেই। আরাকানের গৃহযুদ্ধের উত্তাপও এসে পড়ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। বিঘ্নিত হচ্ছে নাগরিক নিরাপত্তা। সংঘাতের মধ্যেও চলছে মানব পাচার, মাদক চোরাচালান ও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, যা সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।

শুধু বাংলাদেশ কেন? মিয়ানমারের সকল প্রতিবেশী দেশই কমবেশি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংঘাতের ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যার কারণে। বিশেষ করে, সার্ক ও আশিয়ান জোটের দেশগুলো মিয়ানমারের গণহত্যা, বাস্তচ্যুতি ও সংঘাতের কারণে সরাসরি ছোট বা বড় ক্ষতির সম্মুখীন।  তারপরেও দেশগুলো মিয়ানমারকে থামাতে উদ্যোগী হচ্ছে না কেন, এটি একটি বড় প্রশ্ন। কেন সংঘাত বন্ধে ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে শক্তিশালী আঞ্চলিক পদক্ষেপ নিতে পারছে না প্রতিবেশী দেশগুলো, তার কারণ খুঁজে বের করাও জরুরি।

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কিছু উদ্যোগ নিতে দেখা যায় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়াকে। মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি সেখানকার সংঘাত থামাতে তৎপর বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে ও সসম্মানে স্বদেশ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সচেষ্ট।

অন্যদিকে মালয়েশিয়া বলেছে, মিয়ানমার সংকট সমাধানে প্রধান অগ্রাধিকার দেবে দেশটি। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, ‘আসিয়ানের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার চেয়ারম্যানশিপের সময় প্রধান অগ্রাধিকার হবে মিয়ানমার সংকটের সমাধান।’ তার বক্তব্য সাহসী, মানবিক ও আশাব্যঞ্জক।

উল্লেখ্য, দেশটির ‘নিউ স্ট্রেইটস টাইমস’ প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, আসিয়ানকে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক ব্লক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শান্তি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কার্যকর নীতি অত্যন্ত জরুরি। মিয়ানমারের পরিস্থিতি সমাধান এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আসিয়ানের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিহার্য।

২০২৫ সালে মালয়েশিয়া ‘অন্তর্ভুক্তি এবং স্থায়ীত্ব’ থিমের অধীনে আসিয়ানের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে। এই সময়ে ৩০০-এর বেশি সম্মেলন ও বৈঠক আয়োজন করবে মালয়েশিয়া। এর মধ্যে রয়েছে আসিয়ান অর্থনৈতিক মন্ত্রীদের রিট্রিট, আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক এবং ৪৭তম আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন।

লাওস থেকে দায়িত্ব গ্রহণের পর মালয়েশিয়া আশা প্রকাশ করেছে যে, আসিয়ানের নেতৃত্বে তারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবে।

আসিয়ানের ইতিহাসে পঞ্চমবারের মতো নেতৃত্বে দিচ্ছে মালয়েশিয়া। এর আগে ১৯৭৭, ১৯৯৭, ২০০৫ ও ২০১৫ সালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মতো অন্য প্রতিবেশী দেশগুলো যদি আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হয়, তাহলে মিয়ানমারের সংঘাত নিরসনের পথ প্রশস্ত হবে আশা করা যায়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আরাকানে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ হবে বলেও প্রত্যাশা করা যায়। একই সঙ্গে মিয়ানমারের উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিরাপদে ও সম্মানের সাথে স্বদেশের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর উদ্যোগে। আরাকান যখন আরেক ফিলিস্তিনে পরিণত হয়েছে, তখন প্রতিবেশী দেশগুলোর ঘুমিয়ে থাকা কাম্য ও সমীচীন নয়। আর বিষয়টি কেবলমাত্র বাংলাদেশ বা মালয়েশিয়ার নয়। মিয়ানমারের আশেপাশে অবস্থিত কমপক্ষে কুড়িটি দেশের মানবিক ও নৈতিক দায়িত্বও বটে।

এ জি এম নিয়াজ উদ্দিন: রিফিউজি ও বাস্তুচ্যুতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গাদের নিয়ে আরও গবেষণা ধর্মী ও তথ্য বহুল লেখা ও প্রচার প্রচারণা বেশী বেশি প্রয়োজন। এভাবেই হয়ত বিশ্ব নেতাদের নজরে আসবে রোহিঙ্গাদের সমস্যা।

Asik Mahmud
১৫ জানুয়ারি ২০২৫, বুধবার, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Bangladesh Army

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status