প্রথম পাতা
শাহবাগে ব্লকেড দিনভর ভোগান্তি
স্টাফ রিপোর্টার
১০ জানুয়ারি ২০২৫, শুক্রবারপিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা মামলার জামিন ও চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে দুইদিন ধরে শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বিডিআর ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। গতকাল এই মামলার জামিন শুনানির দিন ধার্য থাকলেও
এজলাস কক্ষে দুর্বৃত্তের দেয়া আগুনে বিচার কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। তাই নিজেদের দাবি আদায়ে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল ‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেছেন আন্দোলনরত বিডিআর ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। এদিকে দিনভর জনবহুল এলাকার রাস্তা আটকে অবস্থান করায় এলাকাটি দিয়ে চলাচল করা যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে ২০০৯ সালের পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনায় কারাগারে থাকা ৮৩৪ জন বিডিআর সদস্যদেরকে নির্দোষ দাবি করে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি, চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের পুনরায় চাকরিতে বহাল, বিজিবি’র নাম পরিবর্তন করে আবারো বিডিআর রাখাসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে বুধবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন তৎকালীন চাকরিচ্যুত বিডিআর ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দালনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকারের নেতৃত্বে তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। দিনভর চলা সড়ক অবরোধ ও অবস্থান শেষে রাতে তারা ঘোষণা করেন- বৃহস্পতিবার বকশিবাজারের আলিয়া মাদ্রাসার বিশেষ আদালতে জামিন শুনানি হবে। সেখানে আমাদের সঙ্গীদের মুক্তি ও আশানুরূপ রায় না এলে আমরা শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচি পালন করবো। তবে নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো আদালতের কার্যক্রম চলতে দেয়া হবে না বলে আন্দোলন শুরু করেন আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। মাদ্রাসার গেটে তালা লাগিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশ তালা কেটে গেট খুলে দিলেও মাদ্রাসার মাঠের এক পাশে টিনের চালার আধাপাকা ঘরে তৈরি করা বিশেষ আদালতের এজলাস কক্ষে অগ্নি সংযোগ করা হয়। পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়া হয় বিচারক বসার চেয়ার-টেবিল, কাঠগড়াসহ সমস্ত কিছু। রাতভর চলা অসন্তোষ চলে সকালেও। সকালে বিচার কাজ পরিচালনা করতে এলে সেখানে বিচারক ইব্রাহিম মিয়াও বাধার মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের চীফ প্রসিকিউটর মো. বোরহান উদ্দিন বিচারকের সঙ্গে কথা বলে জানান, বিচার কাজ পরিচালনার মতো পরিবেশ এখানে নেই। বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। তাই আজকের বিচার কাজ মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে। আসামি পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট ফারুক আহমেদ বলেন, আসছে ১৯শে জানুয়ারি এই বিচার কাজ শুরু হবে।
এরপরই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থানে থাকা বিডিআর সদস্যরা শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। আগে থেকেই শাহবাগ থানার সামনে ব্যারিকেড দিয়ে জল কামান, সাঁজোয়া যান নিয়ে অবস্থানে ছিল পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা। তাদের ব্যারিকেড ভেঙে বেলা ১টার দিকে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে আশপাশের সকল রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয় আন্দোলনরত বিডিআর ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। এ সময় তারা বলেন, আমাদের নিয়ে আবারো নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। আমরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সারা রাত শহীদ মিনারে মশার কামড় খেলেও কেউ কোনো খবর নেয়নি। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। আমরা যদি দোষী হই আমাদের ফাঁসি দিয়ে দেয়া হোক না হয় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে আমাদের মাথার কলঙ্ক মুছে দেয়া হোক। ঘণ্টা তিনেক শাহবাগে অবস্থানের পর বিকাল সাড়ে ৩টার পর রাস্তা ছেড়ে আবারো শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থানে বসেন বিডিআরের সাবেক সদস্যরা। এ সময় তারা সরকারকে দুই ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন।
এদিকে হঠাৎ করে শাহবাগের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকার সব কয়টি রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন পথচারীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, ইব্রাহীম কার্ডিয়াকসহ আশপাশের হাসপাতালে আসা রোগীরাও পড়েন চরম বিড়ম্বনায়। ইস্তিয়াক নামে এক সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী বলেন, আমার মা অসুস্থ। তাকে নিয়ে সকালে ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম। এখন আসার পথে দেখি রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। কতবার বললাম আমার মা অসুস্থ। আমাদের সিএনজিটা ছেড়ে দেন। কেউ কথা শোনে না। একজন বলে ছেড়ে দিতে, আরেকজন বলে ছাড়া যাবে না। একটু কষ্ট করেন। রমজান নামে এক সিটি সার্ভিস বাসের চালক বলেন, কোনো কথা নেই বার্তা নেই প্রায় দিনই শাহবাগের রাস্তা আটকে আন্দোলন চলে। কারোর না কারোর দাবি আছেই। আর আমরা যারা ভাড়ার গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হই, তাদের জমার টাকা ওঠে না। তিনি বলেন, ধার করি দেনা করি মহাজনের ভাড়ার টাকা দিতেই হবে। এদিকে শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচি চলাকালে একাধিক বাস পাশাপাশি থাকায় দরজা দিয়ে নামতে না পেরে বাসের জানালা দিয়ে নিচে নামতে দেখা যায় অনেক মানুষকে। শরীয়তপুর থেকে তাবলীগ জামায়াতে ঢাকায় আসা এমনই ৫-৭ জনের দলে ছিলেন মো. রফিক। তিনি বলেন, কী আর করার। বাসের দরজা দিয়ে নামার অবস্থা নেই, তাই জানালা দিয় বের হচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা ঢাকার তেমন কিছুই চিনি না। শুধু বাসের নাম জানি। কিন্তু এখানে বাসও থেমে গেল। এখন কোন বাসে কোথায় যাবো কিছুই মাথায় আসছে না। যানবাহন না পেয়ে ক্রেচারে ভর দিয়ে গতকাল দুপুরে শাহবাগ পার হচ্ছিলেন মো. নাহিদ আহমেদ সনি। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই এই শাহবাগে কিছু না কিছু নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন চলে। কোনো রিকশা পর্যন্ত যেতে দিচ্ছে না। ডাক্তার হাঁটতে নিষেধ করেছে। তারপরও বাধ্য হয়ে ভাঙা পা নিয়ে ক্রেচারে ভর দিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, এত দাবি মানুষের আগে ছিল না। ৫ই আগস্টের পর থেকেই মানুষের যত দাবি উঠেছে। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জিম্মি করে এভাবে আন্দোলন করার কারোর অধিকার নেই। তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে তারা খোলা ময়দানে গিয়ে আন্দোলন করুক। শাহবাগের মতো রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকার রাস্তা বন্ধ করে কেউ যেন বসে থাকতে না পারে এজন্য প্রশাসনকে ও সংশ্লিষ্টদেরকে আরও কঠোর হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। মিরাজ নামে এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, আমি এই বারডেম হাসপাতালে চাকরি করি। একটা কাজে গুলিস্তান গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখি রাস্তা বন্ধ। তিনি বলেন, এদের কতো অনুরোধ করলাম আমার অফিস এখানে, আমাকে যেতে দেন। কিন্তু কেউ কোনো কথা শোনে না। বলে ঘুরে যান। কিন্তু আমি ১০ কিলোমিটার ঘুরে এলেও তো আমার অফিসের সামনেই রাস্তা বন্ধ। আমি গাড়ি নিয়ে ঢুকবো কী করে?
এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, আমরা তাদেরকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা আমাদেরকে অতিক্রম করে শাহবাগের রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এরপরও আমরা অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছি। তিনি বলেন, প্রায় দিনই এমন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করায় সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। আমরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলেছি। কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই আমাদের সাধ্যমতো রাজধানীবাসীর ভোগান্তি কমাতে শাহবাগমুখী যানবাহনগুলোকে বিকল্প রাস্তায় ডাইভার্ট করে দিচ্ছি। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত এসব আন্দোলনকারীরা সাধারণ মানুষের কথা না ভাববে ততদিন ভোগান্তি দূর হবে না।
বিডিআর হত্যার বিচার করতে হবে
শাহবাগ থেকে সকল আন্দোলন বন্ধ করা হোক, নাহয় আন্দোলনের জন্য ইজারা দিয়ে হাসপাতালগুলো সরিয়ে ফেলা হোক.