শেষের পাতা
জনশক্তির অসমাপ্ত কাজ: বাংলাদেশ কি ব্যতিক্রম হতে পারে?
মাইকেল কুগেলম্যান
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার
দেখা গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ অর্থনৈতিক চাপ, দমন, দুর্নীতি এবং দায়মুক্তির দ্বারা ক্ষুব্ধ হয়ে একটি আন্দোলন শুরু করে কর্তৃত্ববাদী সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে- এটি এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং তার বাইরেও বহুবার ঘটেছে। সমপ্রতি বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ বাংলাদেশেও এই ঘটনা ঘটেছে। গত গ্রীষ্মে, ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। নিরাপত্তা বাহিনী নির্মমভাবে ক্র্যাকডাউন করার পর তাদের আন্দোলন একটি গণসরকারবিরোধী প্রচারণায় রূপ নেয়; যার জেরে ক্ষমতাচ্যুত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও জনগণের শক্তি আন্দোলনের রাজনীতিকে উজ্জীবিত করে; তবে তারা প্রায়শই দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের সুযোগ আছে, কিন্তু কাজটা সহজ হবে না।
জনশক্তির মিশ্র রেকর্ড
জনশক্তির ধারণাটি ১৯৮৬ সালে ফিলিপিনসে উদ্ভূত হয়েছিল যখন গণবিক্ষোভ কর্তৃত্ববাদী শাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এটি দেশে গণতন্ত্রের সূচনা করে। কিন্তু ২০২২ সালে মার্কোস পরিবার ক্ষমতায় ফিরে আসে। মার্কোসের পুত্র তার পিতার দমনমূলক শাসনকে অস্বীকার করার জন্য সংশোধনবাদের প্রচার করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আরও সামপ্রতিক উদাহরণ হলো- ২০০০-এর গোড়ার দিকে মধ্য এশিয়ায় কালার রেভেলিউশন বা ‘রঙের বিপ্লব’ আজও এই অঞ্চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ২০১০-এর দশকে আরব বসন্ত আন্দোলন মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় কর্তৃত্ববাদী শাসকদের পুনরুত্থান রোধ করতে পারেনি। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিবেশী, পাকিস্তানে একটি গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলন ২০০৮ সালে সামরিক শাসনের অবসান ঘটায়। কিন্তু আজ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে সেখানে রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাপক বিক্ষোভের পর ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার স্থলাভিষিক্ত হন রনিল বিক্রমাসিংহে, যিনি রাজাপাকসের মিত্র। দেখা যায় রাজাপাকসের অনুগতরাই মন্ত্রিসভা চালাচ্ছেন। এই বছর আশার আলো জাগিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে বসেন কুমারা দিশানায়েকে। তিনি রাজাপাকসের শাসনকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ২০২২ সালের বিক্ষোভকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। তবে শ্রীলঙ্কার কিছু মানুষ তার দলের গণতান্ত্রিক সততা নিয়ে উদ্বিগ্ন: কারণ এটি একসময় একটি সহিংস মাওবাদী বিদ্রোহী গোষ্ঠী ছিল এবং নিঃশর্তভাবে শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তামিলদের বিরুদ্ধে সরকারের নৃশংস অভিযানকে সমর্থন করেছিল।
সামনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার নয়
গণতান্ত্রিক একত্রীকরণ ছাড়া বাংলাদেশ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারাকে বজায় রাখতে পারবে না বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা সেক্টরে বড় শূন্যতা তৈরি করেছে, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সুযোগ করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি আল-কায়েদা অনুপ্রাণিত সন্ত্রাসী নেতাকে আগস্টে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল এবং সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কয়েক ডজন যুবক অক্টোবরে ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকার মধ্যদিয়ে মিছিল করেছিল। তরুণ বাংলাদেশি ছেলেদের জিহাদের প্রতিশ্রুতি দেয়ার ভিডিওগুলোও সেই সময়ে সামনে এসেছে। উপরন্তু, টানা ১৫ বছর শাসন করার পর হাসিনা যখন রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে তখন বাংলাদেশের রাজনীতি অত্যন্ত অস্থির অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় ফিরতে চায়। কিন্তু ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকের কিছু সময়ে ক্ষমতায় থাকাকালীন এটি আওয়ামী লীগের মতোই দমনমূলক নীতি নিয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রথমদিকে অভ্যুত্থান ঘটানো সেনাবাহিনী হাসিনার শাসনামলে ব্যারাকের আড়ালে ছিল। কিন্তু দেশের বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতা সেনাবাহিনীকে একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভূমিকার দিকে ঠেলে দিয়েছে সেনাপ্রধান এখন রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন। এটি ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে কিছু সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন সেনাবাহিনী পূর্ববর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা ঐকমত্য নেই। প্রতিবাদী নেতারা সাবেক কর্তৃত্ববাদী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার একক লক্ষ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল এর পরের কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। বিএনপি আগাম নির্বাচন চায়, কিন্তু অন্যরা তা স্থগিত রাখতে চায়। প্রতিবাদী নেতারা রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য আরও সময় চাইতে পারেন। সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে সময় চাইতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে চায়-বিশেষ করে যে দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং সামগ্রিকভাবে অকার্যকারিতায় জর্জরিত।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা এই সংস্কারকে প্রতিহত করতে পারে এই ভয়ে যে, সংস্কার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে পারে, যা তাদের ক্ষমতা ও পৃষ্ঠপোষকতা বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। আরও বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে, নির্বাচনের জন্য একটি সুস্পষ্ট সময়সীমার অনুপস্থিতি এবং রাজনৈতিক উত্তরণ অনিশ্চয়তাকে বাড়িয়ে তুলবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অস্থিরতা বাড়তে পারে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকার অর্থপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়ন করার পর যখন একটি চূড়ান্ত নির্বাচন হবে তখন ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারও সিস্টেমকে উল্টে দিতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার কঠিন অবস্থানে রয়েছে
অন্তর্বর্তী সরকার একটি কঠিন অবস্থানে রয়েছে; বড় আকারের সংস্কার এবং গণতন্ত্রীকরণের জন্য উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার সঙ্গে জনগণের মনে প্রত্যাশার পারদ এখন তুঙ্গে। কিন্তু যদি সংস্কার প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায় এবং বাংলাদেশের অস্থির অর্থনীতির উন্নতি না হয়, তাহলে জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনসমর্থন প্রভাবিত হতে পারে। সর্বোপরি এই সরকার অনির্বাচিত। পাবলিক ম্যান্ডেটের অভাব রয়েছে। এত কিছুর পরেও, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য আশার আলো নেভেনি। কারণ এটি পুনরুদ্ধারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শক্তিশালী নতুন রাজনৈতিক নেতাদের আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা বিক্ষোভের ছাত্রনেতারা অন্তর্ভুক্ত যাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন অন্তর্বর্তী সরকারে দায়িত্ব পালন করছেন।
এই নেতারা বাংলাদেশি তরুণ তুর্কিদের অনুপ্রাণিত করেছেন- ২৫ বছর বয়সী এই তরুণরা দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তারা হিন্দু মন্দিরগুলোকে চরমপন্থিদের থেকে রক্ষা করার জন্য পাহারা দিয়ে চলেছে, পুলিশ দ্বারা পরিত্যক্ত রাস্তায় যান চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে, লুট করা নগদ ও অস্ত্রশস্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছে এবং শান্তির পক্ষে ম্যুরাল আঁকা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের অন্যতম বিশিষ্ট গণতন্ত্রপন্থি মানুষ। তিনি স্বদেশীদের বিশেষ করে বাংলাদেশি যুবকদের কাছ থেকে গভীর শ্রদ্ধার পাত্র। চেকোস্লোভাকিয়ার ভ্যাকলাভ হ্যাভেল থেকে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়ার কিম ডাই-জং পর্যন্ত- ভিন্নমতাবলম্বীদের ক্ষমতা গ্রহণ এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে সাহায্য করার উদাহরণ প্রচুর। ইউনূস ও ছাত্রনেতারা বাংলাদেশের পরিবারভিত্তিক ও অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতাদের মোকাবিলা করার জন্য একটি নতুন দল গঠনের কথা উড়িয়ে দিতে পারেন না।
বিষাক্ত রাজনীতির ঊর্ধ্বে
বাংলাদেশের নতুন নেতাদের বিষাক্ত রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। ড. ইউনূস ছিলেন হাসিনার কট্টর সমালোচকদের একজন। পূর্ববর্তী শাসনের সমর্থকরা ইউনূসকে ক্ষমতায় চায় না, যা দেশের তিক্ত মেরূকরণের রাজনীতিকে তীব্র করতে পারে।
এদিকে বিক্ষোভকারী নেতারা বলেছেন, তাদের রাজনৈতিক দাবি পূরণ না হলে তারা আবারো রাজপথে ফিরবেন। তারা জোর দিয়েছিল যে, সরকারের কোনো সামরিক পদচিহ্ন থাকা উচিত নয়। এর মানে নতুন দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। উপরন্তু এই নতুন রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা করা যেকোনো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রচেষ্টা পুরনো সমস্যাগুলোর ঝুঁকি বাড়াতে পারে। গণতন্ত্রীকরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যেমন সেনাবাহিনী দ্বারা নতুন রাজনৈতিক কৌশল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র মধ্যে শত্রুতা বা সহিংসতায় ইন্ধন জোগাতে পারে। ধর্মীয় চরমপন্থিদের উৎসাহিত করতে পারে।
জনশক্তির অসমাপ্ত কাজ
জনশক্তির এই আন্দোলনগুলো প্রায়শই গণতন্ত্রীকরণের কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়- যেমন দমন ও দায়মুক্তির প্রতি অপর্যাপ্ত নজরদারি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বৃহৎ বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং মানবাধিকার জোরদার করা; প্রতিশোধের রাজনীতির অবসান; এমন সংস্কারের সূচনা করা যা সরকারি প্রতিষ্ঠানে আরও জবাবদিহিতা বাড়াবে এবং অবশেষে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করবে। অনেক বাংলাদেশির জন্য একটি সফল যুব-নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলন দীর্ঘ অস্থিরতাকে ভেঙে দিয়েছে এবং দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক নতুন আশা জাগিয়েছে। সময়ই বলে দেবে এই ধরনের অনুভূতির পরিণতি কী হবে। সেই আশাবাদ ভুল প্রমাণিত হলে তাহলে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশও গণতন্ত্রের অভাবের সঙ্গে জনশক্তির অসমাপ্ত কাজের সর্বশেষ অনুস্মারক হয়ে উঠবে।
লেখক: ওয়াশিংটন, ডিসিতে উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক। এই নিবন্ধটি ঘচজ-এর ২০২৪ সালের গ্লোবাল ইলেকশন সিরিজের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।