মত-মতান্তর
লিখলেই কি লেখক? খেললেই খেলোয়াড়? গাইলেই শিল্পী?
শায়ের খান
২২ ডিসেম্বর ২০২৪, রবিবারবিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। প্রশ্নটা দুই যুগ আগেও ছিল না। সামাজিকভাবেই উত্তরটা সেটেলড ছিল।
ছোটবেলায় ‘ডক্টর কুদরত-ই-খুদা একজন বিজ্ঞানী’ শুনে চোখ বড় করেছিলাম। বিশ্বাসই হয়নি। বিজ্ঞানী মানে তো আর্কিমিডিস, নিউটন বা আইনস্টাইন। কুদরত-ই-খুদা বিজ্ঞানী হতে যাবেন কোন দুঃখে? ছোটকালে বিজ্ঞানী মানে বুঝতাম অতিমানব জাতীয় কেউ। সাধারণের মানে অসাধারণ। আসলে তারা ছিলেনও তাই। বই-পুস্তকে বড় বড় সব বিজ্ঞানী পশ্চিমের দেখে ভাবতাম, বিজ্ঞানী হতে হলে ওইসব দেশেই জন্মাতে হয়। অথচ আমাদের বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই একজন বিজ্ঞানী। তা আবার যা-তা বিজ্ঞানী না, নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী। অনেকে জানেনই না যে বিক্রমপুরের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন। অথচ আমাদের পাঠ্যপুস্তকে পড়তে হয়েছে রেডিওর আবিষ্কারক মার্কনী। জগদীশ চন্দ্র ৮ মাইল পর্যন্ত কোনো তার ছাড়া কথা পাঠাতে পেরেছিলেন। তাহলে আবিষ্কার তো হয়েই গেল। চিন্তা করেন, আপনি কাওরান বাজার থেকে মাইক্রোফোনে আস্তে করে ‘হ্যালো’ বললেন , সেটা অন্য আরেক যন্ত্রে শোনা গেল বেইলি রোডে। তো আবিষ্কারের বাকি থাকলো কি? ব্যাচারার হাতে আর এগুনোর টাকা ছিল না। ব্যস, ধনাঢ্য বিজ্ঞানী মার্কনী আবিষ্কার করলেন রেডিও। তা-ও জগদীশেরই সহায়তায়। সেই গল্প আরেকদিন হবে। জগদীশ চন্দ্র বসু ‘গাছের জীবন আছে’ এটিও আবিষ্কার করেছিলেন। তা না হলে তিনি হয়তো ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতেন। গাছের জীবন আবিষ্কারে তেমন যন্ত্রপাতির ঝামেলা ছিল না বলেই কি জগদীশ নিজের ক্রেডিট বা স্বত্বটা রাখতে পেরেছিলেন? তার মানে কি যন্ত্রপাতি বা ডিজিটাল জগৎটা এদিক সেদিক বা চালাকির জগৎ?
বিজ্ঞানীর কথা দিয়ে শুরু করেছি কারণ পৃথিবীর সব সৃষ্টিশীল কাজেরই গোড়া হচ্ছে বিজ্ঞান। একজন বিজ্ঞানী ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার মধ্যে পার্থক্য আছে। অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানী সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, তার আবিষ্কার মানুষের উপকার করে। এজন্যই বড় বড় বিজ্ঞানীদের মানুষ সম্মান করে। প্রকৃত বিজ্ঞানীরা সৎ হয়ে থাকেন। বিদ্যুৎ বিজ্ঞানী আর বিদ্যুৎ প্রকৌশলী যেমন এক না, তেমনই বিদ্যুৎ প্রকৌশলী আর বৈদ্যুতিক লাইনম্যানের কাজের ক্ষেত্র ভিন্ন। তাহলে লেখক?
এটা এখন এক বিপজ্জনক প্রশ্ন। অথচ এই প্রশ্নও দুই যুগ আগে সেটেলড ছিল। পছন্দ থাক বা না থাক, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল বা সৈয়দ মুজতবা আলী লেখক কিনা, এ নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। যদিও সাবেক স্বৈরাচার এরশাদও কবিতা আর গান লিখতেন। সেই গান এন্ড্রু কিশোর গাইতেন। শোনা যায়, এগুলো নাকি অন্যরা লিখে দিতেন। এদিকে আবার বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও অবসরে ভায়োলিন বাজাতেন। চমৎকার বাজাতেন। মানুষ সামনা সামনি বসে শুনেছে। উনার ভায়োলিন তো ভূতে বাজিয়ে দিতো না। তিনি নিজেই বাজাতেন। মোদ্দা কথা, বিজ্ঞান-সাহিত্য-ক্রীড়া-শিল্প এসবের চর্চা হচ্ছে স্বভাবজাত। এখানে একধরনের সততা থাকতে হবে। এরশাদের কবিতা-গান হলে হবে না, আইনস্টাইনের ভায়োলিন হতে হবে। থাকতে হবে আপামর মানুষের গ্রহণযোগ্যতা। আপনি সুন্দর পারফরম্যান্স করে জনপ্রিয় হলেন আর ব্যক্তিজীবনে থাকলেন চরিত্রহীন, তাহলে আপনি কখনোই শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী বা খেলোয়াড় না। নিঠুর হিটলারও চিত্র প্রদর্শনীতে যেতেন। পেইন্টিংসের প্রতি ছিল তার দুর্বলতা। কিন্তু সেটা কি কোনো অর্থেই তাকে মহিমান্বিত করবে? হলিউড সুপারস্টার পল নিউম্যান, গ্রেগরি পেক, স্যার রজার মুর, এলিজাবেথ টেইলর বা অ্যাঞ্জেলিনা জোলিরা কি অসৎ ছিলেন? বরং তারা তাদের সারাজীবনের উপার্জিত বৈধ টাকার একটা বিশাল অংশ মানবতার কাজে ব্যয় করেছেন। গায়িকা শাকিরার ডোনেশনের টাকায় আফ্রিকায় বহু স্কুল হয়েছে। সেসব স্কুলে হাজারো শিশু পড়াশোনা করে। হলিউডের মুভি নির্মাতা সোফিয়া লোরেনের হাজব্যান্ড কার্লো পন্টি বা লেজেন্ড ডিরেক্টর আলফ্রেড হিচককরা ছিলেন সচ্চরিত্রবান।
মূল্যবোধ ছাড়া আপনি শিল্পী-সাহিত্যিক- ক্রীড়াবিদ হতে পারেন না। আমরা কখনো শুনিনি রিঙের রাজা মোহাম্মদ আলী কোনো স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন বা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। বরং উল্টোটা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে চাননি বলে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। ক্রিকেটের লিজেন্ড স্যার গ্যারি সোবার্স কখনো কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
মূল্যবোধের মোটামুটি বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এই শতাব্দীর তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়া। এই সোশ্যাল মিডিয়া কতোটুকু সোশ্যাল, তা এখন এক বিরাট প্রশ্ন। এখানে দেখা মিলে কোটি কোটি লেখকের। দেখতে পাওয়া যায় লাখে লাখে গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, লাখে লাখে বুদ্ধিজীবী। এর থেকে মেরে ও লিখে, ওর থেকে মেরে সে বলে। যার যত ভিউ, সে তত বড়। ছোটকালে আমরা ঢাকায় যাত্রাপালার এক সুপারস্টারের নাম শুনেছিলাম। প্রিন্সেস লাকী খান। তার যাত্রামঞ্চে উদাম দেহের উদ্দাম নাচের এত ভিউ (ভিউয়ার) ছিল যে শাবানা-ববিতা-কবরীর প্রেক্ষাগৃহ হার মেনেছিল। ইতিহাস তথাকথিত প্রিন্সেসকে কি মনে রেখেছে? ইতিহাস মনে রেখেছে শাবানা ববিতাদেরই। হাউজি খেলার কলদাতাও তাদের ভোলেননি। ৩ নম্বরটি উঠলেই বলে ওঠেন, শাবানা-ববিতা-কবরী, অভিনয়ের তিন সুন্দরী- নাম্বার থ্রি। সো কল্ড সোশ্যাল মিডিয়া যে সামাজিক মূল্যবোধে বড় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, তা আমরা মার্ক জাকারবার্গের আত্ম উপলব্ধি থেকেই জানতে পারি। কয়েক বছর আগে তিনি বলেছেন, তার এই আবিষ্কারটা ভুল ছিল। হয়তো ভালো উদ্দেশ্যেই তিনি আবিষ্কারটা করেছিলেন। ডিনামাইটও আবিষ্কার করা হয়েছিল ভালোর জন্য। মাটির নিচের খনিজ তোলার জন্য পাথুড়ে পাহাড় ফাটাতে। অনেকেই হয়তো জানেন না, নোবেল প্রাইজের জনক আলফ্রেড নোবেল এই ডিনামাইটের আবিষ্কারক। মূল্যবোধ ছাড়া যদি খেলোয়াড় হওয়া যেতো, তবে প্রত্যেক অলিম্পিকে জিমন্যাস্টিকসে স্বর্ণপদকটা জিতে নিতো সুন্দরবন বা অ্যামাজান জঙ্গলের বানর। কিন্তু মুশকিল হলো, স্বর্ণপদক জিততে হলে যে আপনাকে মানুষ হতে হবে। সেটা যে কোনো ক্ষেত্রেই। হতে হবে সাধারণের চেয়ে অসাধারণ।
(লেখক-নাট্যকার-ফিল্মমেকার)
মাশাআল্লাহ! জাযাকাল্লাহ!! দারুণ লিখেছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
তাইতো বলি একটা গান না গাইলেও জনগণ কেন আমাকে একজন বিখ্যাত শিল্পী হিসাবে গণ্য করে।
অসাদারণ..
খুব ভালো সাগলো লিখাটি। পরিতাপের বিষয় ক্রীড়াবিদ অনেকেই হয়তো পড়বেন না।