ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবার, ১১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪ রজব ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

শীতেও ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি

নাজমুল হুদা
৮ ডিসেম্বর ২০২৪, রবিবারmzamin

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শিশু নওশিন। ২৮ মাস বয়স তার। গত ১লা ডিসেম্বর তার জ্বর হয়। দু’দিন পর পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। পরে তাকে ৫ই ডিসেম্বর রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মা শারমিন বলেন, জ্বরের পর মেয়েটা কিছুই খেতে পারতো না। প্লাটিলেট ২৭ হাজারের নিচে নামার পর এখানে ভর্তি করিয়েছি। এখন প্লাটিলেট ৩৬ হাজার রয়েছে। স্যালাইন দিয়ে রেখেছে ডাক্তার। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকায় থাকেন নওশিনের পরিবার। সেখানে অনেক মশার উপদ্রব জানিয়ে শারমিন বলেন, আমাদের ওখানে অতিরিক্ত মশা। সিটি করপোরেশন থেকে মাসে এক-দুইবার ওষুধ দিতে আসে। কিন্তু মশা যায় না। 

বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। শীত আসতে শুরু করলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমে যায়। তবে চলতি বছর শীতেও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। এখনো প্রতিদিন শত শত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিদিনই প্রাণহানি হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৫৬২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ৬ দিনে ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ গত বছর ডিসেম্বরের প্রথম ৬ দিনে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছিলো। অর্থাৎ এই ৬ দিনের গড় মৃত্যু ছিল ৩ জনের মতো। 
বৃষ্টি হওয়ার পর দেড়-দুই মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে উল্লেখ করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এবছর বেশিদিন বৃষ্টি থেকেছে। গত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টি হয়েছে। এখন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। আরও অন্তত ১৫ দিন এই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে। 
নারায়ণগঞ্জের তারাবো এলাকার বাসিন্দা মো. জাফর। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি। গত ৩০শে ডিসেম্বর জ্বর হয় তার। এরপর থেকে প্রতিদিনই থেমে থেমে জ্বর আসে। ফার্মেসি থেকে শুরুর তিনদিন ওষুধ কিনে খেয়েছেন। জ্বর ভালো না হওয়ায় স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হোন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরে ঢাকায় চলে আসেন। জাফর বলেন, একদিনে আমার প্লাটিলেট অনেক কমে যায়। পরে মুগদা হাসপাতালে চলে আসি। এখন আগের চেয়ে একটু ভালো। তার পাশের বিছানায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মো. রফিকও একই এলাকার বাসিন্দা। রফিক বলেন, আমার প্লাটিলেট দেড় লাখ থেকে ৬৭ হাজারে নেমে গেছে। পুরো শরীরে ব্যথা। 
সম্প্রতি দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি জানতে আইইডিসিআর মনসুন এডিস সার্ভে- ২০২৪ এর জরিপে দেখা যায়, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৫৬টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ব্রুটো ইনডেক্স নামে পরিচিত। স্বীকৃত এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে করা হয়। জরিপের ফলে দেখা যায়, রাজধানীর দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৬টি ওয়ার্ডেই ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটির ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩৮, ৯, ৩০, ৭, ৮, ১৮, ২৫, ২৮, ৩৬, ৩৭, ১ এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ড। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪৭, ৫৩, ৬১, ৫০, ২, ১৬, ২৬, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড। এর বাইরে বাকি ওয়ার্ডগুলোর বিষয়ে স্পষ্ট করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপের ফল উপস্থাপন করে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন ডেঙ্গু রোগের বাহকের কীটতাত্ত্বিক জরিপের ফল উপস্থাপন করে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মেয়াদ অনেক বেশি। অন্যান্য বছরে জুন-অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু থাকলেও এ বছর ডিসেম্বর মাস শুরু হলেও এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিদ্যমান। এ প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার লক্ষ্যে ঢাকার দুই সিটির মধ্যে একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। 

শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে নতুন ভর্তি হওয়াদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৫৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৮ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬৪ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১২৩ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৩৬ জন, খুলনা বিভাগে ৪৭ জন রয়েছেন। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৩৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮ জন, রংপুর বিভাগে ২ জন এবং সিলেট বিভাগে ৪ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এদিকে গত এক দিনে সারা দেশে ৫০৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৯২ হাজার ৭০২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৯৫ হাজার ৬৩২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৫২২ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন।

জলবায়ু পরিবর্তন ও দেশের মৌসুমের পরিবর্তনের জন্য এখন সারা বছরই ডেঙ্গু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে মহামারির মধ্য দিয়ে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একইসঙ্গে এটা মৌসুমি থেকে বাৎসরিক রোগেও পরিবর্তন হয়েছে। এ ছাড়া ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করার জন্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো কার্যক্রম একেবারেই না থাকার ফলে মশা ও ডেঙ্গু বাড়ছে বলেও জানান তিনি। 

এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, সাধারণ মানুষ তার বাড়িঘর, আঙ্গিনা বা এডিস মশা জন্মানোর যে পরিবেশ সেটি নিজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে যেন মশার প্রজনন হতে না পারে। প্রতিবেশীকেও উৎসাহিত করবে। শিশুরা যখনই ঘুমাবে যাতে মশারির ভেতরে রাখা হয় এবং পুরো শরীর ঢাকা থাকে এমন পোশাক যাতে পরানো হয়। বেশি মশা রয়েছে এমন জায়গায় গেলে, মশা তাড়ানোর ক্রিম ব্যবহার করতে পারে। যদি কারও কোনো ধরনের জ্বর হয়, তাহলে সেটি যেন অবহেলা না করে। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়। প্রয়োজনে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তাহলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা নেয়া যাবে।

পাঠকের মতামত

Learnt the statistics of mosquito and dengue. What is the strategy to control mosquito?We need to know how to kill mosquito.Otherwise these statistics have no value.

Hamid Miah
৮ ডিসেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৮:৩৪ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Hamdard

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status