মত-মতান্তর
বাংলাদেশি মুসলিম উদারতা ও সহনশীলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত
শায়ের খান
৮ ডিসেম্বর ২০২৪, রবিবারধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলা হলেও বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এদেশের প্রায় ৯২ শতাংশ মুসলমান। ১৫ কোটিরও বেশি। আগে মুসলিম জনসংখ্যায় প্রথম ইন্দোনেশিয়ার পরেই বাংলাদেশ ছিল। এখন বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে। মজার বিষয়, পাশের দেশ ভারতে বাংলাদেশ থেকে বেশি মুসলমানের বসবাস। ২০ কোটিরও বেশি। বাংলাদেশে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হিন্দু ১ কোটির কিছু বেশি, বৌদ্ধ ১০ লাখের কিছু বেশি ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রায় ৫ লাখ। বিশ্ব স্বীকৃত মুসলিম দেশ বাংলাদেশ ওআইসি’র সদস্য।
একটা দেশ সম্পর্কে ফ্ল্যাট ধারণার জন্য উপরের চিত্রটা যথেষ্ট। কিন্তু একটা দেশকে শুধু অঙ্ক দিয়ে চেনা যায় না। ব্যক্তি মানুষের যেমন চরিত্র থাকে, দেশ জাতিরও তেমন চরিত্র থাকে। দেশের চরিত্র বা চেহারায় সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস বা আদর্শের ছায়া থাকে। তা হতে পারে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক। যেমন চীন বললেই অনেকে ভাবেন বৌদ্ধ দেশ। আসলে সেখানে ৩৩ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ। বাকি সব অবিশ্বাসী বা অন্য ধর্মের। চীন কমিউনিস্ট দেশ হিসেবেই বেশি পরিচিত। একই কথা রাশিয়ার জন্যও। রাশিয়া ভাবলেই মনে হয় সমাজতন্ত্র। সৌদি আরব বা ইরান বললেই রক্ষণশীল ইসলাম ভেসে ওঠে। যদিও এদের মধ্যে কিছু সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পার্থক্য আছে। আমাদের দেশের অনেকেই পাকিস্তানে কট্টর ইসলাম দেখতে পান, অথবা দেখতে চান। ক্রিকেট শক্তি হিসেবে উদয় না হলে এখনো অনেকে আফগানিস্তানকে ভিন্ন চোখেই দেখতেন। ভুটান বললেই একটা পাহাড়ি অবয়ব ভেসে ওঠে। বিশ্বের একমাত্র হিন্দু দেশ নেপাল। অথচ ভারতকে মানুষ ভাবে হিন্দুত্ববাদের তীর্থস্থান। এর কারণ, ভারত পরিচয়পত্রে নিজেকে সেক্যুলার বললেও দৃশ্যমান হয়েছে হিন্দু দেশ হিসেবে। স্ক্যান্ডিনাভিয়ান দেশগুলো যেমন সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড বললেই মনে হয় সুশীল দেশ। সুদান অথবা সোমালিয়া বললেই অনেকে চমকে ওঠেন। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকা বললে মনে হয় বেশ উন্নত। আর্জেন্টিনার একটা রাজনৈতিক চরিত্র থাকলেও ব্রাজিল বলতেই মানুষ বোঝে ফুটবল আর সাম্বা। ভ্যাটিকান সিটি মানেই খ্রিষ্টান দেশ। আবার খ্রিষ্টান অধ্যুষিত হলেও আমেরিকা-বৃটেনকে কেউ খ্রিষ্টান দেশ বলে না। কেউ বলে উদার দেশ, কেউ বলে বিশ্ব মোড়ল। সোজা কথা, ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র আছে।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম। তাই এদেশের সংস্কৃতি বা জীবনাচারে মুসলিম প্রভাব থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। অনেকে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে এক ভাবেন। আসলে তা না। সংস্কৃতি হচ্ছে- একটা দেশের বেশির ভাগ মানুষ নিয়মিত যা দেখে, শুনে, চিন্তা বা চর্চা করে- সেটা। এটা সত্যের ওপর দাঁড়ানো। আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে আপনি সাংস্কৃতিক ইভেন্টের মাধ্যমে যা দেখান, সেটা। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতে পারে সত্য, আংশিক সত্য বা মিথ্যা। উদাহরণ দেই। ঢাকাকে বলা হয় ‘মসজিদের শহর’। ঢাকায় ৫ বেলা আজান হয়। আপনি ঢাকার যেখানেই থাকেন, আজান শুনবেনই। এটাই সংস্কৃতি। আর আপনি কোনো সাংস্কৃতিক ইভেন্টে ঢাকার কিছু দেখাতে গিয়ে আজান বা মসজিদ নাও আনতে পারেন। সেটা হবে ঢাকা সম্পর্কে আপনার ন্যারেটিভ, সংস্কৃতি না। আজান বিষয়ে আমার টিভি নাটক শুটিংয়ের এক ইন্টারেস্টিং ঘটনা মনে পড়লো।
তখন আমি নতুন নতুন ডিরেকশন দিচ্ছি। শুটিং চলাকালে লক্ষ্য করলাম- আজান শুরু হলেই যন্ত্রচালিতের মতো শুটিং বন্ধ হয়ে যায় আমার অনুমতি ছাড়াই। জিজ্ঞাসা করায় বলে ‘আজান হচ্ছে’। যেন এটাই শুটিংয়ের অলিখিত আইন। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম ধর্মীয় রীতিকে সম্মান করে। পরে বুঝেছিলাম অডিও ইস্যু। আমরা টিভি নাটক শুট করার সময় ভিডিও আর অডিও একসঙ্গে নেই। আজানের শব্দ নাটকে ঢুকে যাবে, সেজন্য আজানের সময় শুটিং বন্ধ রাখা হয়। আমি প্রশ্ন রাখলাম, আমরা বাস্তব জীবনে কি আজান শুনি না? তাহলে নাটকে না কেন? এই যে আজান শোনা গেল- এটা সংস্কৃতি আর আপনি আজান না শুনিয়ে গল্পটা শোনালেন- এটা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। নিজস্ব ন্যারেটিভ। মসজিদের শহর ঢাকার টিভি নাটকগুলোয় দূর থেকে আসা আজান খুব একটা শোনা যায় না। দরকার না হলে আজান না শোনালে অসুবিধা নেই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দরকারই হয় না। অথচ ইন্ডিয়ান টিভি সিরিয়ালে দুঃখ কষ্টে পড়লেই মা-নানিরা পূজার ঘরে ঢুকে যায়। ভারতের নাটক-মুভিতে বিয়ে দেখাতে পুরোহিতের মন্ত্রের সঙ্গে কলাগাছে সাত পাঁক- উলুধ্বনি একটা কমন বিষয়। আমাদের নাটক-মুভিতে বর কনের ‘কবুল’ বা মঙ্গল চেয়ে মোনাজাত দেখা যায় না বললেই চলে। আমরা ‘হলুদ বাটো, মেন্দি বাটো’ আর সানাই বাজিয়ে ছেড়ে দেই। তাহলে কি, ইন্ডিয়ান টিভিগুলো ধর্মানুরাগী আর আমাদের টিভিগুলো
ধর্ম এড়িয়ে চলে?
বাংলাদেশের মুসলিমরা উদার ও সহনশীলতার জন্য বিশ্বে উদাহরণ হতে পারে। অথচ মুসলিমদের পক্ষে এই সত্য কথাটা আপনি এদেশের কিছু ছাড়া বেশির ভাগ গণমাধ্যমে পাবেন না। মনে হয়, বেশির ভাগই যেন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে একটি কট্টর মুসলিম দেশ হিসেবে দেখাতে আগ্রহী। অথচ বিষয়টা পুরাই উল্টো। প্রথমে সফট লাইনটা দেখি। আর তা দেখতে আমাকে ছোটবেলায় যেতে হচ্ছে।
আব্বা ছিলেন প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার এক প্রজেক্টের বড় কর্মকর্তা। কর্মচারীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন ‘খান সাহেব’ মানে আব্বা। খেলা? যাও খান সাহেবের কাছে। ফাংশন, পূজা বা ওয়াজ মাহফিল? যাও খান সাহেবের কাছে। একবার দুর্গাপূজা আর শবেমেরাজ একসঙ্গে পড়েছে। আব্বা পড়লেন বিপদে। তিনি দুর্গাপূজায় বিশেষ অতিথি আবার শবেমেরাজের ওয়াজ মাহফিলে বিশেষ অতিথি। দুই জায়গায়ই ডোনেশন দিয়েছেন। মসজিদে কেনা হয়েছে একটা গরু। জবাই করে মাহফিলে রাতে রান্না হবে গরুর বিরিয়ানি। পূজামণ্ডপ দেখা শেষে আব্বার সঙ্গে গেলাম মসজিদে। প্রধান হুজুর লেকচারে অভিমান করে বললেন, ‘ আমাদের শ্রদ্ধেয় খান সাহেবের মন বড় কিন্তু মুশকিল হইলো স্যার পূজায় যেই টাকা দেন, মাহফিলেও সেই টাকা দেন।’ আব্বা হো হো করে হেসে দিলেন। মাইকে ওয়াজ হচ্ছে আর বড় বড় ডেকচিতে গরুর বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। মিডনাইটে মসজিদের বিশাল কংক্রিট ফ্রন্ট ইয়ার্ডে কলাপাতা নিয়ে লাইনের পর লাইনে বসে গেছে ক্ষুধার্ত গরিব মিসকিন। আমিও। আব্বা জানতেন না আমি আছি। দেখে আবারো হো হো করে হেসে বলেন, ‘বেটা তুই বাসায় যাস নাই? ‘অধস্তনরা হই হই রই রই করে আমাকে ভালো কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে চাইলে আব্বা উনাদের থামিয়ে দেন। বলেন,‘আস্তে। ও এখানেই সবার সঙ্গে কলাপাতায় খাবে।’ মুহূর্তের মধ্যে এক ঝাঁক অবাক অধস্তনদের কাছে ‘খান সাহেব’ হয়ে গেলেন ‘সাম্যের প্রতীক’।
এবার একটু হার্ড লাইনের আলাপ করি। বিষয়টা ২৫- ৩০ বছর আগেও এতটা ছিল না। কথায় কথায় রাজাকার, সংখ্যালঘু, উগ্রবাদী আর মুসলিম আলেমদের ওপর ঘৃণার চাষ। কে কবে কোন ছিদ্র দিয়ে এসব শুরু করেছে সে আলাপে না যাই। প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি এদেশের ইসলাম চর্চাকারীরা উগ্র? আমি বলছি- মোটেই না।
তুরাগ নদীর পাড়ে দশকের পর দশক ধরে প্রতি বছর তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিমরা আসেন। বিশাল প্যান্ডেল টাঙিয়ে লাখো মানুষ রাতের পর রাত থাকে, খায়, ধর্ম পালন করে। প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী নেতাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেখানে যায়। বহু বহু বছর ধরে এই অনুষ্ঠান শুধুমাত্র ভলান্টিয়ার দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করেছে মুসল্লিরা। কোনো তথাকথিত বুদ্ধিজীবীকে কখনো দেখেছেন এই চমৎকার সুশৃঙ্খল অনুষ্ঠানটিকে মহিমান্বিত করে কিছু বলতে? বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিলো মুসল্লিরা। গুলি করে তাদের ২২ জনকে মেরে ফেললো পুলিশ। গ্রেপ্তার হলো হাজার হাজার আলেম। সহনশীল থাকলো মুসলিমরা। প্রতিবাদ সমাবেশ কি উগ্র কিছু? প্রায় ১০ বছর আগে মতিঝিল শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণ অবস্থান প্রতিবাদের ওপর চলেছিলো গণহত্যা। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কি মুসলিম উগ্রবাদ?
বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে ‘মৌলবাদী’ আর ‘সংখ্যালঘু’ বিষয় দুটোর বেশ অপব্যবহার হচ্ছে। অথচ সংখ্যাগুরু মুসলিমরা এ বিষয়ে সহনশীল। উদাহরণ দেই। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে জনৈক বাপ্পাদিত্য বসু একজনকে পিটিয়ে মেরে সেই লাশের উপর নৃত্য করেছিলো। কখনো কোনো মুসলিমকে বলতে শুনেছেন যে একজন হিন্দু একজন মুসলিমকে মেরে তার লাশের উপর নৃত্য করেছে? বরং বলা হয়, মানুষকে সাপের মতো পিটিয়ে তার উপর নৃত্য করা হয়েছে। এটা কি শব্দচয়নে এক ধরনের সহনশীলতা না? সম্প্রতি তথাকথিত ইসকন নেতার ঘটনায় সন্ত্রাসী আক্রমণে চট্টগ্রামে এক আইনজীবী নিহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় কি কোনো মুসলিম কোনো সংখ্যালঘুকে আক্রান্ত করেছে? কোনো মুসলিম কি বলেছে যে, হিন্দু হামলায় মুসলিম আইনজীবী নিহত হয়েছে? অনেকে মনে করেন, এর উল্টোটা ঘটলে হয়তো ন্যারেটিভ অন্যরকম হতো। আসলে প্রকৃত উগ্রবাদ কি ও কোথায়? এর উৎস খুঁজে দেখা দরকার। এদেশের মুসলিমরা যদি উগ্র হতো তবে ১৫ কোটির মুসলিমের দেশে ৩০ হাজার পূজামণ্ডপে শান্তিপূর্ণ দুর্গাপূজা হয় কি করে?
পশ্চিমা বিশ্বকে আমাদের দেশ সম্পর্কে বছরের পর বছর ভুল ধারণা দেয়া হয়েছে। এদেশে পশ্চিমা বন্ধুদের অফিস আছে। তারা তাদের কাজেই এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যান। তারাই ভালো বলতে পারবেন, কোথাও তারা কোনো মুসলিম উগ্রতার শিকার হয়েছেন কিনা। আমি শিওর- হননি। বরং সম্মানিতই হয়েছেন।
মজার একটা উদাহরণ দেই। শাহবাগে সাঁকুরা নামে একটা পর্যটন বার ও রেস্টুরেন্ট আছে। বহু পুরনো। মজার বিষয়, এই পানশালার গাড়ি পার্কিং-এর সঙ্গেই আছে একটি বহুতল আবাসিক মাদ্রাসা। এটাও বহু পুরনো। কখনো কি শুনেছেন যে কোনো মাদ্রাসা ছাত্রের হাতে কোনো মাতাল আক্রান্ত হয়েছে? এটা তো সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এই বাংলাদেশে মুসলমানরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী স্বদেশীদের সঙ্গে যেভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে, তা একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশি মুসলিমরা উদারতা ও সহনশীলতায় বিশ্বের আকাশে এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্র।
লেখক-নাট্যকার-ফিল্মমেকার
অসংখ্য ধন্যবাদ, লেখককে। এমন উপস্থাপনা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা দরকার। খু্বই ভাল লাগলো লেখাটি।
Exactly ....
ধন্যবাদ লেখককে অসাধারণ স্মৃতি নির্ভর ও অভিজ্ঞতালদ্ধ বাস্তব সত্য তুলে ধরার জন্য। আমাদের সকলের উচিত সম্প্রীতির বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করা।
পশ্চিমে বাংলায় লেখা এই অসম্ভব সুন্দর ও বাস্তবানুগ কথাগুলো খুব বেশী লোকের কাছে পৌঁছাবে না। ইংরেজিতে অনুবাদের অনুরোধ জানাই।
Excellent comment indeed.
অসাধারণ খান সাহেব, ইংরাজীতেও ছাপানো উচিত যেন এই সাম্যের ছবিটি সবাই বুঝতে পায়.......