ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

জাপানের ইউক্রেন নীতির বিপদ: শতবর্ষী জাপান-রুশ সামরিক দ্বন্দ্বের পুনরুজ্জীবন

ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির

(১ বছর আগে) ১ মে ২০২২, রবিবার, ৭:৩৪ অপরাহ্ন

mzamin

ইউরোপীয় নেতা-নেত্রীদের দেন-দরবারে কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে সামরিক পরাশক্তি রাশিয়া হীন সামরিক শক্তিসম্পন্ন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করলো। রাশিয়ার উদ্দেশ্য ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান থেকে বিরত রাখা। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ইউরোপে, কিন্তু আঁচ পড়েছে এশিয়ায়। এশিয়ায় পশ্চিমা শক্তির অনুগামীরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্যে কোয়াড জোটের সদস্য হিসাবে জাপান প্রত্যক্ষভাবেই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং রাশিয়াকে সতর্ক করে বিবৃতি দিয়েছে। ২০শে মার্চ জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা রাশিয়াকে যুদ্ধ ক্ষান্ত করে তার আগ্রাসী সশস্ত্র বাহিনীকে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। রাশিয়া জাপানের এই ইউক্রেন নীতির প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই অক্টোবর মস্কোতে স্বাক্ষরিত রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) ও জাপানের মধ্যকার যু্দ্ধ সমাপ্তি বিষয়ক যৌথ ঘোষণা স্থগিত করে দিয়েছে। এর ফলে শতবর্ষী জাপান-রুশ সামরিক দ্বন্দ্বের পুনরুজ্জীবন ঘটলো।    

জাপান আপাতভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু এর পররাষ্ট্রনীতি স্বাধীন নয়। কারণ জাপানের পররাষ্ট্রনীতি প্রত্যক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এই নির্ভরশীলতা জাপান লাভ করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজয় ও আত্মসমর্পণের ফলশ্রুতিতে। মিত্রশক্তির কাছে জাপানের সামরিক পরাজয় ছিলো স্বাভাবিক, কিন্তু আত্মসমর্পণের বিষয়টি ছিলো অস্বাভাবিক। কারণ মিত্রশক্তির কাছে সামরিক ও কৌশলগতভাবে হেরে, জাপান স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির কাছে পরাজয় বরণ করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির কাছে জাপানের আত্মসমর্পণটি ছিলো স্বেচ্ছাকৃত। এই স্বেচ্ছাকৃত আত্মসমর্পণের পিছনে যে কারণ নিহিত ছিলো তা হলো সোভিয়েত রাশিয়া (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) থেকে প্রবল গতিতে ধেয়ে আসা সামরিক আগ্রাসন ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ঢেউ। বস্তুত: রাশিয়া জাপানের প্রতিবেশী এবং রাশিয়া ও  জাপান-এই দুই দেশের মধ্যে রয়েছে শতবর্ষী কূটনৈতিক, কৌশলগত ও সামরিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে মেইজি যুগে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও এই নীতির অনুসরণে কোরীয় উপদ্বীপ ও চীনসহ রাশিয়ার দাবীকৃত উত্তর-পূর্ব এশীয় ভূখণ্ডে রাশিয়া কর্তৃক দাবীকৃত অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিক্রিয়া থেকে। মেইজি বিপ্লবের সাফল্যে জাপান দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যাবাদী শক্তি হিসাবে অবির্ভূত হয়। ঠিক সে সময় পরাক্রমশালী রুশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিও চলছিলো। এই বিস্তৃতির প্রয়াসে রাশিয়া  ক্রমান্বয়ে চীন ও কোরিয়ায় বৃহত্তর অঞ্চলজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করছিলো। কাজেই চীন ও কোরীয় উপদ্বীপে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রুশ ও জাপান সাম্রাজ্যের কৌশলগত সংঘাত সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় দুই দেশের মধ্যে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো সামরিক সংঘাত শুরু হয়। প্রথমবারের এই সংঘাতে জাপানের লক্ষ্য ছিলো রুশ সাম্রাজ্যের প্রশান্তমহাসাগরীয় নৌবহর। এই যুদ্ধ ২ বছরের মতো স্থায়ী হয়। এই সামরিক সংঘাতে জাপান জয়ী হয়। অতপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই যুদ্ধ বিরতি চুক্তির ফলে দূরপ্রাচ্যে রাশিয়া ও ক্ষীয়মাণ চীনের বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদী জাপানের সামরিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

উক্ত চুক্তির ফলে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যেকার সামরিক দ্বন্দ্বে বিরতি ঘটে। কিন্তু কূটনৈতিক ও কৌশলগত দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকে। এই সুপ্ত দ্বন্দ্ব আবার প্রকাশ্যে আসে যখন জাপান মাঞ্চুরিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারের সাফল্য থেকে উদ্দীপিত হয়ে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়া প্রভাবাধীন রাষ্ট্র মঙ্গোলিয়ায় অভিযান চালায়। এই অভিযানের ফলে সামরিক সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং দুই দেশের মধ্যেকার এই যুদ্ধ ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জাপানের পরাজয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। যুদ্ধ শেষে আবার উভয় দেশ যুদ্ধ বিরতিতে রাজী হয় এবং ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল এক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি সোভিয়েত-জাপান অনাক্রমণ চুক্তি নামে অভিহিত হয়। কিন্তু যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, তুষের আগুনের মতো মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এই দ্বন্দ্ব আবার প্রকাশ্যে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়া যখন পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মানীকে মোকাবেলায় ব্যস্ত, ঠিক তখন জাপান সুযোগ বুঝে চীনে অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়। 

 

উল্লেখ্য যে, জাপান তখন এশীয় মূলখণ্ডের মাঞ্চুরিয়াসহ চীন অধিকার করে আরও বৃহত্তর ভূখণ্ড অধিকারে ব্যপৃত ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটলে রাশিয়াসহ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড ইত্যাদি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ জার্মানীর আগ্রাসন মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকায় জাপান তার পূর্ণাঙ্গ সামরিক শক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশসমূহে এশীয় উপনিবেশসমূহ দখলে ব্যপৃত হয়। এই অভিযানে জাপান একচ্ছত্রভাবে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার ইউরোপীয় উপনিবেশসমূহ দখল ও অধিকার করে নিজেদের সাম্রাজ্য কায়েমে ব্যপৃত হয়। কিন্তু জাপানের এই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইউরোপীয় রণাঙ্গণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত মিত্রশক্তির কাছে অক্ষশক্তির অংশীদার জার্মানীর পতন ঘটলে জাপানের রাজনৈতিক ভাগ্যে অমানিশা নেমে এসে। প্রথমত, জাপান যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির ব্যাপক সামরিক অভিযানের শিকার হয় এবং বিভিন্ন রণাঙ্গনে একের পর এক জাপানের পতন ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে ৬ ও ৯ই আগষ্ট হিরোশিমা ও নাগাসাকি বন্দর শহরে পারমাণবিক বোমা  বিস্ফোরণ ঘটায়। যুদ্ধের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হয়। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে জাপানের সামরিক কর্তৃত্বকে হতবাক করে দেয়। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে জাপানের সামরিক কর্তৃত্ব হীনবল ও হতবিহ্ববল হয়ে পড়ে। কিন্তু তখন পর্যন্তও জাপানের সামরিক নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণের মতো বিষয় বিবেচনায় ছিলো না। কিন্তু নতুন সামরিক ঘটনা জাপানের সামরিক নের্তৃত্বকে ভাবিয়ে তুলে। এই সামরিক ঘটনা হলো রাশিয়ার পূর্ব রণাঙ্গণে প্রত্যাবর্তন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মে মিত্রশক্তির নিকট জার্মানীর চূড়ান্ত পরাজয় সূচীত হলে, সোভিয়েত রাশিয়া তার পূর্ণ সামরিক শক্তি নিয়ে দূরপ্রাচ্যগামী অভিযান শুরু করে। সাথে নিয়ে আসে নতুন রাজনৈতিক মতবাদ; যার নাম সমাজতন্ত্র। সমরাস্ত্র যেমন ভৌত ভূখণ্ড অধিকারের ক্ষমতাবাহী, অন্যদিকে সমাজতন্ত্র হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ক্ষমতাবাহী। মননে সমাজতন্ত্র আর বাহুতে সমরাস্ত্র- এই দুই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে, সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিলে সম্পাদিত অনাক্রমণ চুক্তিকে ৫ই এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাতিল ঘোষণা করে এবং জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর ধারাবাহিকতায় সোভিয়েত রাশিয়া ৯ই আগস্ট নাগাসাকিতে দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের দিনটিতে জাপানের হোক্কাইডো প্রদেশস্থ কুরিল দ্বীপপুঞ্জসহ বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। সে সময় সোভিয়েত রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী কোরীয় উপদ্বীপ, তাইওয়ান, চীন ও মঙ্গলিয়ায় যুদ্ধরত হীনবল ও ছত্রভঙ্গ সামরিক ও বেসামরিক জাপানি নাগরিদেরকে ব্যাপকভাবে বন্দি করে সাইবেরিয়ার বন্দি শিবিরে নিয়ে যায়। সোভিয়েত রাশিয়াকৃত ধৃত এসব জাপানি যুদ্ধবন্দির সংখ্যা ছিলো আনুমানিক ৬ থেকে ৮ লক্ষ। পর্যুদস্ত জাপান রাশিয়ার এই সামরিক ক্ষিপ্রতায় ভীত হয়ে স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের আক্রমণ থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়া গ্রহণ করে। কিন্ত সোভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধবন্দি হিসাবে ধৃত জাপানি নাগরিকদের নিয়ে নতুন খেলা শুরু করে। তারা জাপানি যুদ্ধবন্দিদের শিক্ষানবীশ নাম দিয়ে তাদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রবিষ্ট করতে প্রয়াসী হয়। এর ফলশ্রুতিতে জাপানি যুদ্ধবন্দিদের একটি অংশ জাপানের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে এবং সমাজতান্ত্রিক মতবাদে উদ্দীপিত হয়ে বিপ্লবী হয়ে উঠে। এভাবে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন কর্তৃক সামরিক অভিযানের ভীতি এবং অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্দীপিত সাইবেরিয়ার বন্দি শিবিরের সমাজতন্ত্রীপন্থি জাপানীদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর হুমকি- এই দুই প্রকার বিপদ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে ছত্রছায়া দান করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ার কারণে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন থেকে আগত এসব বিপদ থেকে জাপান সাময়িকভাবে রক্ষা পায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। এর এক পর্যায়ে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ৮ই সেপ্টেম্বর যুদ্ধাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জাপান ও সোভিয়েত রাশিয়াসহ ৪৯টি দেশ এই শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই শান্তিচুক্তি সানফ্রন্সিস্কো শান্তিচুক্তি নামে অভিহিত। এই শান্তিচুক্তির ফলে সোভিয়েত রাশিয়া ৫ই এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের বিরুদ্ধে যে সামরিক অভিযান শুরু করে তা থেকে ক্ষান্ত দেয়। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক দখলকৃত কুরিল দ্বীপপুঞ্জ রাশিয়ার অধিকারে রয়ে যায়। সানফ্রন্সিস্কো শান্তিচুক্তিতে কুরিল দ্বীপপুঞ্জে জাপানের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে যায়। ততোদিনে বিশ্ব রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে দুইভাগে বিভক্ত হতে থাকে। এই রাজনৈতিক মতবাদের প্রশ্নে একদিকে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ধারা ও অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদী ধারায় জোটবদ্ধ হতে থাকে। শুরু হয় স্নায়ুযু্দ্ধ বা ঠাণ্ডা লড়াই।

স্নায়ুযুদ্ধ চলমান থাকার এক পর্যায়ে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে এক শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এই শান্তি আলোচনা শেষে সোভিয়েত রাশিয়া ও জাপান ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই অক্টোবর মস্কোতে এক যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে। এই যৌথ ঘোষণার ফলে ৫ই এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিরাজিত সোভিয়েত রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। এই শান্তি আলোচনার ফসল হিসাবে জাপান কুরিল দ্বীপপুঞ্জের ৪টি দ্বীপের মধ্য থেকে শিকোতান ও হাবোমাই দ্বীপ দু’টি ফেরত পায় আর ইতুরূপ ও কোনাশিরি-এ দু’টি দ্বীপ সোভিয়েত রাশিয়ার অধিকারে রয়ে যায়। কিন্তু জাপান এই দু’টি দ্বীপের মালিকানার দাবী ত্যাগ করেনি। এরপর থেকে জাপানের সাথে সোভিয়েত রাশিয়ার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর জাপান ও রাশিয়ার মধ্যকার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। গত কয়েক দশকে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যকার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাপান কুরিল দ্বীপপুঞ্জ সংলগ্ন শাখালিন দ্বীপে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের জন্য বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করে।

শতবর্ষব্যাপী চলমান কূটনৈতিক, কৌশলগত ও সামরিক দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে জাপান ও রাশিয়া যখন স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরে এসেছে, ঠিক তখনই ইউক্রেন সংকট জাপান-রাশিয়া সম্পর্কে নতুন এক নেতিবাচক অনুষঙ্গ যুক্ত করেছে। এ বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেইন আক্রমণ করে। রাশিয়ার উদ্দেশ্যে হলো ইউক্রেইনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানে বিরত রাখা ও রাশিয়ার অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব নড়েচড়ে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। আর জাপান ইউক্রেন প্রশ্নে এই পশ্চিমা দেশসমূহকে অনুসরণ করছে। কারণ জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়া গ্রহণ করায়, জাপানে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সুযোগ নেই। অন্যদিকে জাপান গণচীনের চীন সাগরে একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে গঠিত সামরিক জোট কোয়াড জোটে যোগদান করায়, জাপানের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে অনুসরণ করা ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। জাপান ইতোমধ্যে ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং জাপান ইউক্রেইনের উপর রাশিয়ার আগ্রাসন জাতিসংঘ সনদের গুরুতর লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেছে। এরই মধ্যে জাপান রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জাপান ইউক্রেইনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য বরাদ্দ করে চলেছে।

রাশিয়া জাপানের উক্ত ইউক্রেইন নীতির প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই অক্টোবর মস্কোতে স্বাক্ষরিত সোভিয়েত রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যু্দ্ধ সমাপ্তি বিষয়ক যৌথ ঘোষণা স্থগিত করে দিয়েছে। এই ঘোষণার ফলে রাশিয়া ৫ই এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো তার পুনরুজ্জীবন ঘটলো। এই ৫ই এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার অর্থ হলো রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজিত রয়েছে এবং রাশিয়া যে কোনো সময় জাপান আক্রমণ করতে পারে। এভাবে পশ্চিমা দেশসমূহের পররাষ্ট্রনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জাপান যে ইউক্রেন নীতি গ্রহণ করলো, তার মাধ্যমে জাপানের রাশিয়া নীতিও প্রতিফলিত হয়েছে। আর রাশিয়া এখন জাপানের প্রতি বিক্ষুদ্ধ, যা নতুন যুদ্ধ পরিস্থিতির নতুন এক শর্ত তৈরি করেছে। জাপানের ইউক্রেন নীতির কারণে রাশিয়া যদি ক্ষতির সম্মুখীন হয় তবে জাপানের প্রতি রাশিয়ার সামরিক প্রতিক্রিয়া তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।    

[লেখকঃ অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ; পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট। ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়। ভূতপূর্ব অভ্যাগত শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়।] 
 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status