প্রথম পাতা
পদ হারানো মেয়ররা পলাতক, আছে ব্যতিক্রমও
মারুফ কিবরিয়া
২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবারআওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপর দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রদের প্রায় সবাই পালিয়ে গেছে। সরকার পতনের পর ১৯শে আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাদের অপসারণ করে। এরপর থেকে অভিভাবকহীন অবস্থাতেই চলছে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম। পদ হারানো অধিকাংশ মেয়র পালিয়ে বেড়ালেও তাদের মধ্যে তিনজন ব্যতিক্রম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া এবং মেয়র পদ থেকে সরানো হলেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন তারা। তবে জনসম্মুখে আসছেন না। কেউ নিজ বাস ভবনেই রয়েছেন। সাবেক এই তিন সিটি মেয়র হলেন- নারায়ণগঞ্জ সিটির সেলিনা হায়াৎ আইভী, গাজীপুরের জায়েদা খাতুন ও রংপুরের মোস্তাফিজার রহমান। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ও সরকার পতনের কোনো প্রভাবও তাদের ওপর পড়েনি। বরং পালিয়ে যাওয়া মেয়রদের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)।
২০২২ সালের ১৬ই জানুয়ারি বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকারকে বিপুল ভোটে হারিয়ে তৃৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়রের পদে আসীন হন সেলিনা হায়াৎ আইভী। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবেই তিনি অপরাজিত থাকেন। এরপর টানা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন আইভী। ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। কিছুদিন পর মেয়র পদ থেকে সরতে হয়েছে আইভীকে। এ সময় দেশজুড়ে বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের মেয়ররা পালিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা মেয়র তখন নারায়ণগঞ্জেই অবস্থান করেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলা দেয়া হয়। কিন্তু সাবেক এই মেয়রের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের হয়নি। অবশ্য সিটি করপোরেশনে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান শুরু করেছে আইভীর বিরুদ্ধে। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে আইভী বলেন, দুদকে জমা পড়া অভিযোগগুলো ২০২১ সালের। এগুলো আমার নির্বাচনের আগের। এতদিন দুদক অনুসন্ধান করেনি কেন? যাই হোক, দুদক যদি অনুসন্ধান করে প্রমাণ পায় আমি দোষী তাহলে আমার শাস্তি হবে। আমি তো পালিয়ে যাইনি।
২০২৩ সালের ২৫শে মে অনেকটা নাটকীয়ভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহকে হারিয়ে আরেক আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে জয়ী হন। জায়েদা খাতুন নামে মেয়র থাকলেও বিগত এক বছর ধরে ছেলেই সামলান সব। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে হামলা হয়। সব পুড়িয়ে দেয়া হয়। পালিয়ে যান জাহাঙ্গীর আলম। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জায়েদা খাতুন গাজীপুরেই রয়েছেন। এমনকি ৫ই আগস্টের পর মেয়র পদ অপসারণের দিনও তিনি নগর ভবনের নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০২২ সালের ২৭শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী লুৎফা ডালিয়াকে হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান। মেয়র পদে দায়িত্ব নিয়ে বাকি থাকা সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কাজ করতে থাকেন তিনি। তবে ১৯শে আগস্ট পদ থেকে সরানো হলেও নিজ এলাকায় অবস্থান করেন মোস্তাফিজার। এ মুহূর্তে তিনি রংপুর শহরেই রয়েছেন।
পলাতকদের কার অবস্থান কোথায়: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ৩রা আগস্ট দেশত্যাগ করেছেন। জানা যায় ওইদিন সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান তিনি। গণঅভ্যুত্থানের পর তাপসের বিরুদ্ধে বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করা হয়। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান করছে দুদকও। গত ২৪শে অক্টোবর তাপসসহ বেশ কয়েকজনকে তলব করা হয়। তবে তার আগেই দেশ ছাড়েন তিনি।
২০২৩ সালের ২৫শে মে নির্বাচনে জয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো খুলনা সিটির হাল ধরেন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। ৫ই আগস্টের পর তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। খুলনা শহরের কোথাও তাকে দেখা যায়নি। এরপর একাধিক মামলাও হয় তালুকদার আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে।
একই সময়ে বরিশাল সিটির দায়িত্ব নেন আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর চাচা তিনি। এক বছরের কিছু বেশি সময় দায়িত্ব পালনের মধ্যেই গণঅভ্যুত্থানের পর পদ হারান খোকন সেরনিয়াবাত। এই সময়ের মধ্যেই নানা অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেগুলো অনুসন্ধান করছে দুদক। এ ছাড়া বিএনপি’র কার্যালয় ভাঙচুরসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে খোকন সেরনিয়াবাতসহ ৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বরিশাল কোতোয়ালি থানায়। জানা গেছে, ৫ই আগস্টের পর থেকে বরিশালের কোথাও দেখা যায়নি সাবেক এই মেয়রকে।
রাজশাহীর সিটি মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে লাপাত্তা তিনি। হত্যা মামলারও আসামি করা হয়েছে লিটনকে। জানা গেছে, ৫ই আগস্টের পরেই তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন।
ময়মনসিংহ সিটির মেয়র ছিলেন ইকরামুল হক টিটু। গণঅভ্যুত্থানের পর তিনিও গা ঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন শহরে না থাকলেও ময়মনসিংহের কোথাও লুকিয়ে রয়েছেন টিটু।
গেল বছর সিলেট সিটি করপোরেশনে প্রথমবারের মতো মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে তারও কোনো সন্ধান মেলেনি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবেক এই মেয়র বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনে চলতি বছরই ভোটে জয়ী হয়েছিলেন স্থানীয় এমপি আকম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনা। ৫ই আগস্ট সকালেও নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তিনি। তবে ওইদিন শেখ হাসিনার পালানোর খবরে বাবা-মেয়ে দু’জনই ভারতে পাড়ি জমান।
সিটি করপোরেশন কার দায়িত্বে: ১৯শে আগস্ট সব সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ অপসারণ করা হলে ওইদিনই স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রশাসক নিয়োগ করে। এতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মহ. শের আলীকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক মো. মাহমুদুল হাসানকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটিতে আদালতের রায়ে বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করছেন, খুলনার বিভাগীয় কমিশনারকে খুলনা সিটি করপোরেশন, রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনারকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারকে সিলেট সিটি করপোরেশন, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে বরিশাল সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম কামরুজ্জামানকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) মহাপরিচালককে (অতিরিক্ত সচিব) কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, রংপুরের বিভাগীয় কমিশনারকে রংপুর সিটি করপোরেশন, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন প্রশাসক করা হয়েছে।
পলাতকদের অনেকেই প্রশাসনের সহায়তা পেয়েছে।