ঢাকা, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক হান কাং এর উপন্যাসে মানবিকতা

গাজী মিজানুর রহমান

(১ সপ্তাহ আগে) ৩০ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:২৫ পূর্বাহ্ন

mzamin

দক্ষিণ কোরিয়ার লেখিকা হান কাং ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ৫৩ বছর বয়সী হান এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের ১৮তম নারী, যিনি সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান এই পুরস্কার জিতলেন। দেশের  ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতি সচেতন হান তাঁর প্রতিটি  গ্রন্থে দক্ষিণ কোরিয়াবাসীর  দুঃখ-যন্ত্রণার  কথা এবং দুঃশাসনের  বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তুলে  ধরেছেন। ব্যক্তিজীবন এবং সমাজজীবনে যেসব মানুষ নানাভাবে বঞ্চিত, বিশেষভাবে নারীরা, তাদেরকে হান কাং সহমর্মিতার জায়গা থেকে তাঁর লেখায়  এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে তাঁর গদ্য কাব্যের চরিত্র পেয়েছে। নোবেল কমিটির মতে, কাব্যময় গদ্য কোরিয়ান সাহিত্যে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সউল থেকে  ২৬৯ কি. মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত গোয়াংজু সিটিতে ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর হান কাং জন্মগ্রহণ করেন। হান এর বয়স যখন ৯ বছর তখন তিনি  পিতা-মাতার সাথে  ভাই-বোন-সহ সউল মহানগরীতে এসে বসবাস  শুরু করেন। হান পরিবারের প্রায় সকলেই লেখক। পিতা হান সাং ওয়ান ও ভাই হান ডং-রিম দুজনেই তাঁর মতো ঔপন্যাসিক। অপর ভ্রাতা হান কাং-ইন একজন কার্টুনিস্ট ও ঔপন্যাসিক। সউলের ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হান কাং কোরিয়ান ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি সাংবাদিক হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর সউল ইন্সটিটিউট অব আর্টস এর সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার প্রথম পরিচয় তিন লেখক।

হান কাং এর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি ২০১৫ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডেবোরা স্মিথ। এটা তাঁকে  ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার এনে দেয়। একরাতে ভীতিকর এক স্বপ্ন দেখে ইয়াং হাই নামের এক কর্মজীবী বিবাহিতা নারী মাছ-মাংশ ছেড়ে  শুধু সবজি খেতে শুরু করেন। শুধুমাত্র এই কারণে একজন  নারী পরিবারের অন্যদের অত্যাচারের লক্ষ্যে পরিণত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারান। উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীদের নিষ্পেষিত জীবনের একটি  দিনিলিপি। প্রকারান্তরে ইয়াং হাই এর গল্প জাপানী শাসনের সময় অসংখ্য নারীকে ‘কম্ফোর্ট উম্যান’ হিসেবে নিপীড়িত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়।

হান কাং এর দ্বিতীয় উপন্যাস হিউম্যান এক্টস ২০১৪  সালে প্রকাশিত হয়। গোয়াংজু গণহত্যার স্মৃতির  উপর ভিত্তি করে এই উপন্যাস রচিত। ১৯৮০ সালের মে মাসের ১৮ তারিখ  থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত  হানের জন্মশহর, দক্ষিণ কোরিয়ার  গোয়াংজুতে তখনকার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-মিছিল সংঘটিত হয়। সামরিক শাসক চান ডু হোয়ানের সশস্ত্র বাহিনী  প্রায় ২৩০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। হান কাং এর পরিবার গোয়াংজুর যে বাড়িতে থাকতেন, সেটা বিক্রয় করে তারা সউলে চলে এসেছিলেন মে মাসের ঘটনার আগেই। সেই বাড়ি কিনেছিল যে পরিবার, তাদের ছেলে কাং ডং হো অন্যদের সাথে এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে  প্রাণ হারায়। গণহত্যায় জীবন হারানো এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে যাওয়া আর-কয়েকজন মানুষের কথা নিয়ে উপন্যাসটির গল্প বিস্তার লাভ করেছে ।

১৯৪৮-৪৯ সালে জেজু দ্বীপে যে বর্বরতা চালায় তৎকালীন সরকারের সশস্ত্র বাহিনী, তার উপর ভিত্তি করে হান কাং এর অপর উপন্যাস ‘উই ডু নট পার্ট ( ২০২১)’ রচিত হয়েছে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র—একজন লেখিকা ও তার বান্ধবী। বান্ধবী ইনসনের অনুরোধে জেজু দ্বীপে তার আটকে থাকা সাদা রঙের পোষা পাখিটাকে বাঁচাতে যায় লেখিকা কিয়ংহা। সেখানে গিয়ে জেজু দ্বীপের দুঃখজনক অতীত ইতিহাস জানতে পারেন তিনি। জেজু দ্বীপের বাসিন্দারা সে-সময়কার নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দিলে প্রায় ৩০০০০ মানুষ গণহত্যার শিকার হয় এবং জেজু দ্বীপবাসীর উপর বীভৎস নির্যাতন নেমে আসে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি প্রথমদিকে এই বাড়াবাড়ি ধামাচাপা দিলেও পরে তারা তাদের কৃতকর্মের  জন্য ক্ষমা চায় জাতির কাছে। বন্ধুর পরিবারটিও ওই নির্যাতনের শিকার ছিল, যে স্মৃতি তারা বয়ে চলেছে। ‘উই ডু নট পার্ট’  উপন্যাসের বিষয়বস্তু  এই ঘটনা। হান কাং এর অপর দুই গ্রন্ত  ‘দ্য হোয়াইট বুক ( ২০১৮)’ এবং ‘দ্য গ্রীক লেসেনস ( ২০২৩)’ মানব জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণার  কথা বলে। প্রিয়জন হারানোর পর নিঃসঙ্গ জীবনের কুরে খাওয়া দুঃখ দুই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। তারা সীমাহীন দুর্দশার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার জাতিগত ইতিহাস খুবই করুণ। জাপানী পীড়নমূলক শাসন শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। তারপর আবার ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩  সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার সাথে যুদ্ধে নানারূপ আপদ নেমে আসে। এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত  দীর্ঘকালীন সামরিক শাসন দেশটিকে নিস্পেষিত করে দেয়। এই সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন, গুম, ক্রস-ফায়ার চলেছে বিনা বাধায়। এসবের বিরুদ্ধে আগুয়ান ছাত্র জনতার আন্দোলনে শত শত তাজা প্রাণ ঝরে যায়। পঙ্গু হয় অগণিত মানুষ। হান কাং ইতিহাসের এই কালো দিকটি তার উপন্যাস সমূহে তুলে ধরেছেন। তিনি মানবতার পক্ষের মানুষ, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ—নোবেল প্রাইজ ঘোষিত হলে হান কাংকে যখন একটা আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনার কথা বলা হয় , তখন  তিনি বলেন, ফিলিস্তিন এবং ইউক্রেনে যেভাবে মানুষ মারা হচ্ছে, তাতে তিনি এমন সংবর্ধনার কথা ভাবতেই পারেন না। নোবেল কমিটির মতে হান কাংকে পুরস্কারটি দেয়া হয়েছে তার  “সুতীব্র কাব্যময় গদ্যের জন্য– যা  ইতিহাসের সংকটকে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করে এবং মানব জীবনের ভঙ্গুর দিকটি উন্মোচিত করে।”  

কাব্যময় গদ্যের একটা উদাহরণ তার হিউম্যান এক্টস উপন্যাস থেকে নেয়া যেতে পারে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত অসংখ্য মানুষের লাশ আনা হয়েছে এক শরীর-চর্চা কেন্দ্রের চত্বরে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবী একজন নারী বললেন, ‘ভাই ও বোনেরা, আমাদের ভালোবাসার ধন শহীদদের দেহগুলিকে রেড ক্রস হাসপাতাল থেকে আজ  এখানে আনা হচ্ছে।' একথা বলে তিনি সেই স্কয়ারে জড় হওয়া জনতাকে সাথে নিয়ে একটি সমবেত জাতীয় সংগীত গাইলেন। তার কণ্ঠস্বর অতি দ্রুত শতকন্ঠে হারিয়ে গেল। একটা কণ্ঠস্বরের উপর হাজারটা কণ্ঠস্বরের ভিত রচিত হলো। এটা ছিল ধ্বনিসমষ্টির এক সুউচ্চ অট্টালিকা, যা আকাশ অবধি পৌঁছে যাচ্ছিল। গানের লহরি একেবারে চূড়ায় উঠে পেন্ডুলামের মতো ধীরে ধীরে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। আমাদের অন্য সকলের কণ্ঠ সেই কণ্ঠের সমুদ্রে হারিয়ে যায়। “(অনুবাদ এই প্রবন্ধকারের)। হান কাং এর দেশের সাথে আমাদের জাতীয় জীবনের সংগ্রামী চেতনার প্রভূত মিল থাকায় আমরা তার অমর সৃষ্টির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল হবো, এটাই কাম্য।

 

(গাজী মিজানুর রহমান , সাবেক যুগ্মসচিব ও লেখক )
 

পাঠকের মতামত

চমৎকার উপস্থাপন। অশেষ কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা নেবেন।

Mohammad
২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার, ২:০৭ পূর্বাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status