মত-মতান্তর
ভাসানীকে ঘিরে আমাদের রাজনীতি
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বীরউত্তম
২৬ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবারসেদিন ছিল ১৭ই নভেম্বর রোববার। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ অলি এ কামেল মজলুমের মুক্তিদূত হুজুর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। এত অনাদরে অবহেলায় দিনটি পার হলো যা কল্পনাতীত। আগের বছর ১৭ই নভেম্বর ছিল এক দুঃশাসনের যুগ। কিন্তু এবার তো তেমন ছিল না। তবে কেন এমন অবহেলা, কেন এমন বঞ্চনা? হুজুর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জের ধানগড়ায় জন্মেছিলেন। অল্প বয়সে সবাইকে হারান। এক সময় তিনি টাঙ্গাইলে চলে এসেছিলেন। টাঙ্গাইলেই তার জগৎ বিখ্যাত অলি এ কামেল নাসির উদ্দিন বোগদাদীর সঙ্গে দেখা। শিশু আব্দুল হামিদ খানকে নাসির উদ্দিন বোগদাদী শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার সঙ্গেই তিনি ঘুরেছিলেন ইরাক, ইরান, আরব দুনিয়া। তার সঙ্গেই বগুড়ার পাঁচবিবি জমিদার বাড়ি গিয়েছিলেন। জমিদার বাড়ির গৃহশিক্ষক হিসেবে এক সময় জমিদার কন্যা আলেমা ভাসানীকে বিয়ে করেছিলেন। আমার এক সময় মনে হতো কতো মানুষের কতো পদবি হয়, ‘ভাসানী’ এটা কেমন পদবি? বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মেঘালয়ের ঢালু, মানকারচর, ধুবড়ি, কুচবিহার, মুর্শিদাবাদ, আলীপুর দুয়ার, বর্ধমান হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম। যাবার পথে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ভাসানচরে যাত্রা বিরতি করেছিলাম। সে ছিল এক-দেড়শ’ মুক্তিযোদ্ধার লটবহর। যেখানে জগদ্বিখ্যাত পল্লীগীতি গায়ক আব্দুল আলীম যেমন ছিলেন, গীতিকার লোকমান হোসেন ফকীর, উস্তাদ ফারুক আহমেদ- এমনি আরও অনেক দিকপালরা ছিলেন। ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপাড়ে ভাসানচরে বসেছিলাম। কারণ ফেরি তখন পশ্চিমপাড়ে ধুবড়িতে। আসতে এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যাবে। ফারুক কোরাইশী, গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক রঞ্জিৎ কান্ত সরকার, আতোয়ার রহমান খান, রতন ঠাকুর, নুরুল হুদা, ওয়াহেদুর রহমান লিচু এরা এক সংগীতের আসর বসিয়েছিলেন। অনেকের অনেক গান স্পর্শ করেছিল। তার মধ্যে আব্দুল আলীমের অনেকগুলো গান নাড়া দিয়েছিল। সেই ভাসানচরে হুজুর মওলানা ভাসানী এক মহাসম্মেলন করেছিলেন। যাবার পথে ভাসানচরে অনেকবার মনে হয়েছিল হুজুর মওলানা ভাসানীর নামানুসারে বোধহয় চরটির নাম হয়েছে ভাসানচর। কিন্তু পরে বইপুস্তক ঘেঁটে দেখলাম ব্যাপারটা সম্পূর্ণই উল্টো। ভাসানচরের নামানুসারে জনাব আব্দুল হামিদ খানের নাম হয়েছে ভাসানী। সেই মওলানা ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রায় প্রতি বছরই হুজুর মওলানা ভাসানীর মাজারে যাই। আল্লাহ’র কাছে দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাকে বেহেশতবাসী করেন আর তার রুহানী তাগদে আমরা সুখে- শান্তিতে স্বস্তিতে থাকি।
গত বেশ কতোগুলো বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় হুজুর মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়নি, এবারও হলো না। অন্য বছরগুলো ছিল একটি দলীয় সরকার। যে সরকার কারও কোনো কথা শুনতো না, কাউকে মর্যাদা দিতো না। সে সরকার বা সরকার প্রধান মনে করতো দেশটা তার, দেশটা তার বাবার। তাই হয়তো কাউকে তেমন কোনো পাত্তা দিতো না, দেয়ার কথা ভাবতোও না। দলীয়ভাবে তার মৃত্যুদিনে তেমন কেউ অংশ নিতো না। সরকারিভাবে তো কোনো মর্যাদাই ছিল না। বিএনপি আগাগোড়াই অংশ নেয় কখনো লোক দেখাতে, কখনো আন্তরিকভাবে। বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অনেকবার এসেছে যতটা হুজুরের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে দোয়া খায়ের করতে তার চাইতে বেশি মনে হয়েছে দলীয়ভাবে সাংগঠনিক সভা করতে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এবার মেলা জমেছিল বেশ বড় মাপের। যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে অনেক। হুজুরের ভক্তরা এসবের প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এখন তো জোর যার মুল্লুক তার। কেউ কারও কথা শুনে না। আর প্রবীণদের তো কোনো মর্যাদাই নেই। তা যদি থাকতো তাহলে শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান কই? কারও কোনো যথাযোগ্য মর্যাদা নেই। ৫-৬ দিন সন্তোষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় টেবিল-চেয়ার, খাট-পালঙ্ক, বাক্স-টেকশো’র শত শত দোকান বসেছিল। মনে হচ্ছিল ব্যবসা করার জন্যই যেন হুজুর মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী। বড় কষ্ট হয়, দুঃখ লাগে। যে মওলানা ভাসানীর জন্ম না হলে পাকিস্তান হতো না, পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না সেই বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানীর মৃত্যু দিনেও কোনো গুরুত্ব নেই, শ্রদ্ধা নেই। আমি একজন সাদামাটা মানুষ। এক সময় মনে করতাম হুজুরের মৃত্যুদিনে বেদনায় টাঙ্গাইল মুহ্যমান হয়ে থাকবে, আকুল হয়ে থাকবে মানুষজন, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। কিন্তু না, তা কখনো হয়নি। ধীরে ধীরে দিনে দিনে এইসব বড় মানুষগুলোর প্রতি অনীহা কেন যেন বেড়ে চলেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। লক্ষ-কোটি মানুষ এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাত্র ১১০-১১৫ দিনের মধ্যে সাধারণ মানুষ কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়েছে। বাজারের সে যে কি পরিস্থিতি বলে কয়ে লিখে বুঝানো যাবে না। রাতদিন যারা পরিশ্রম করে তাদের পেটে ভাত নেই। চাল, ডাল, মরিচ, পিয়াজ, আদা, রসুন, কোনো কিছুর দিকে তাকানো যায় না। লাউ, কুমড়া, বেগুন, ঢেঁড়স, কপি, বরবটি যা একসময় বিক্রি করা যেতো না, কোন দাম ছিল না। এখন সোনার দামের সঙ্গে তুলনা চলে। অধ্যাপক ড. ইউনূস এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান। যাদেরকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়েছেন তারা অনেকে আন্তরিক হলেও যোগ্যতার বিষয়টি চিন্তায় আনতে হবে। কারণ প্রায় সবাই অবসরপ্রাপ্ত। অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবসরপ্রাপ্তদের খুঁজে আনা হচ্ছে। যে যাই বলুন, শারীরিক সুস্থতাকেও মূল্য দিতে হবে, মাথায় রাখতে হবে। বয়স পার হয়ে যাওয়া ২-৪ জন নিশ্চয়ই ভালো কাজ করতে পারেন, যুবকের চাইতেও বেশি করতে পারেন। কিন্তু সবাই না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখানেই মস্ত বড় ত্রুটি। তারা যাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের অধিকাংশরাই তেমন দক্ষ, যোগ্য কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নেই। যে কারণে হতাশা বাড়ছে। দেশ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। শুরুর দিকে বিএনপি ভালো করেনি। আওয়ামী লীগ যা করেছে বিএনপি তার চাইতেও বেশি করা শুরু করেছিল। মনে হয় তারেক রহমান নিয়ন্ত্রণের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু কতোটা কি সফল হবেন তা তিনিই জানেন। এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সফল হয়েছেন বলা যাবে না। এরকম একটি সময় যেখানে সবার এক হয়ে কাজ করার কথা তেমনটা হচ্ছে না। এখনো ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতাই বেশি। আর এটা তো সত্য, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা আহত ও নিহত হয়েছেন তাদেরকেও বর্তমান সরকার পুরোপুরি দেখাশোনা করতে পারেনি, পারছে না। যার প্রধান কর্তব্য আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চিকিৎসা করা। সেটাও সন্তোষজনক হয়নি, হচ্ছে না। অন্যদিকে সমন্বয়করাও তাদের সঠিক ভূমিকা পালন করছেন না বা করতে পারছেন না। অতীতের সব মুছে ফেলতে চাইলে দু’দিন পর তারাও যখন অতীত হবেন তাদের কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। অতীতের নোংরামি-ভণ্ডামী প্রতিহত করে সুকীর্তিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করলে এবং সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে অবশ্য অবশ্যই ’২৪-এর জুলাই-আগস্টের সফল আন্দোলনকারীদের ভাবীকাল মাথায় তুলে রাখতো। কিন্তু তারা যেভাবে অতীতকে পদদলিত করার চেষ্টা করছেন তাতে ভবিষ্যতে তারা প্রশ্নের মুখে পড়বেন। সেই কবে কোনকালে ১৯৫৭ সালে কাগমারী মহাসম্মেলনে হুজুর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে প্রথম দেখেছিলাম। বিশেষ করে কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ মাঠে বিশাল জনসভায় বক্তৃতার সময় তার দাড়ির নাচন আজও আমার চোখে ভাসে। তারপর আস্তে আস্তে বড় হয়েছি। অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। ’৬২ সালে আইয়ুবের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলে রাস্তায় নেমেছি। সেই সময় থেকে হুজুর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পায়ে পায়ে চলেছি। দিন যত গেছে গভীরতা তত বেড়েছে। এর মাঝে কতো স্মৃতি কতো কথা। ’৬৯-এর আন্দোলনে একবার হুজুর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খানের ভূঞাপুরে গিয়েছিলাম। সেই ঐতিহাসিক ডাকবাংলোয় বসেছিলেন তিনি। শত শত হাজারো নারী-পুরুষ-বৃদ্ধা তার বেশির ভাগই এসেছিলেন তেল পড়া, পানি পড়া নিতে। হুজুর দোয়া কালাম পড়ে শিশিতে, বোতলে, গ্লাসে, বাটিতে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে উঠে গিয়ে পাশেই এক পাটকুয়ায় ফুঁ দিয়ে এলেন। ১৫-২০ মিনিট পর গিয়ে দেখি সেই কুয়ায় পানি নেই। কেউ কেউ ওর মধ্যেই কাদা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় হুজুর মওলানা ভাসানী নাকি চাঁদে যুক্তফ্রন্টের মার্কা তুলেছিলেন। মনে হয় সে মার্কা আমিও দেখেছি। কারণ চাঁদে যে বুড়ি চরকা কাটে ওটা আমরা ভালোভাবে তাকালেই দেখতে পাই। কারণ আমরা যে ভাবনা নিয়ে নিবিষ্ট মনে চাঁদের দিকে তাকাই তাই দেখতে পাই। ’৫৪-র যুক্তফ্রন্টের মনে-প্রাণে গেঁথে থাকা মার্কাও তেমনি চাঁদে ভেসে উঠতো। সেই মওলানা ভাসানী ’৭৬ সালের ১৭ই নভেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে যান। সেদিন আমি ছিলাম গারো পাহাড়ের পাদদেশে মেঘালয়ের রংরায়। বড় আশা ছিল হুজুরের জানাজায় শরিক হওয়ার। সে সাধ পূর্ণ হয়নি। আজ কতো বছর হুজুর মওলানা ভাসানী নেই। সুখে-দুঃখে যেভাবেই থাকি ১৭ই নভেম্বর তার কবর জিয়ারতে যাবার চেষ্টা করি। এবারো করেছি। কিন্তু অনাদর আর অবহেলা দেখে রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞার কারণে মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। জীবনে কতো কষ্ট করেছি। কখনো তেমন খারাপ লাগেনি। কিন্তু কেন যেন এখন লাগে। বঙ্গবন্ধু তার নিজের যোগ্যতায়, নিজের কর্মক্ষমতায় দেশবাসীর কাছে যতটা প্রিয় আদরণীয় হয়েছিলেন আমাদের কর্তব্য ছিল তাকে সমস্ত দেশবাসীর করে তোলা। কিন্তু তার কন্যা শেখ হাসিনা তার ১৬ বছরের জোর-জুলুম মানুষকে এতটাই ক্ষিপ্ত করে তুলেছিলেন যে, তার কর্মকাণ্ডে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অনেকটা অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধুই যদি না থাকে, স্বাধীনতাই যদি না থাকে, বঙ্গবন্ধুর গুরু হুজুর মওলানা ভাসানীর অস্তিত্বই যদি না থাকে তাহলে আমরা কোথায় থাকি? মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু আর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে ঘিরে আমাদের জীবন, আমাদের রাজনীতি। আমাদের মহান নেতারাই যদি না থাকেন তাহলে আমরা থাকি কোথায়? পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, দয়াময় আল্লাহ যেন হুজুর মওলানা ভাসানীকে বেহেশতবাসী করেন এবং দেশে স্বস্তি ও শান্তি দান করেন।
বাংলা ও বাঙালির কীর্তিমান দিকপাল হুজুর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সেই সাথে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় যিনি টাইপিং করছেন তাঁকে বলছি, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম এর নাম বিরাম চিহ্ন কমা ছাড়া লেখার জন্য।