ঢাকা, ১১ মে ২০২৫, রবিবার, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

নির্বাচনের সময়সূচি: দৃষ্টিকোণ, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ

ড. সিরাজুল আই. ভূঁইয়া

(৫ মাস আগে) ২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৪১ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৩:১৭ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি তার প্রশাসনের প্রথম ১০০ দিনের স্মরণে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছেন। তার বক্তৃতার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল-দেশের নির্বাচনের সময়সূচি। এটি এমন একটি বিষয় যা বাংলাদেশের  রাজনৈতিক বৃত্ত  এবং জনসাধারণের মধ্যে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের  রাজনীতি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ইউনূসের ভাষণে উত্তেজনা দূরীকরণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পথ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। যদিও তার দৃষ্টিভঙ্গি তার দূরদর্শিতার জন্য প্রশংসা অর্জন করেছে। তবে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ জনগণের কাছে সন্দেহ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই নিবন্ধে ইউনূসের ভাষণের একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণ প্রদান করা হলো।

ইউনূসের বক্তব্যের মূল ফোকাস ছিল: নির্বাচনী অখণ্ডতার প্রতি অঙ্গীকার। ইউনূস অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেন। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন যা অতীতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

নির্বাচনের সময়সূচি: নির্বাচনের স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে ইউনূস প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচনের সময়সূচি তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন।

অন্তর্ভুক্তি ও সংলাপ: সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্ব স্বীকার করে ইউনূস জাতীয় ঐকমত্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনার আহ্বান জানান।

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে মনোযোগ: সব রাজনৈতিক নেতাদের জন্য সমান খেলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতো প্রধান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতি মুক্ত করার ওপর জোর দিয়েছেন ইউনূস।

নির্বাচনী অখণ্ডতার ওপর জোর: নির্বাচনের সময়সূচিকে সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নিছক পদ্ধতিগত নয় বরং প্রকৃত গণতান্ত্রিক করার প্রতিশ্রুতির উপর জোর দিয়েছেন ইউনূস। এই পদ্ধতিটি নির্বাচনের আগে সুশীল সমাজের ‘পরিবর্তনের’ দাবির সঙ্গে অনুরণিত হয়।

জাতীয় ঐক্যমতের প্রচার: অন্তর্ভুক্তি ও সংলাপের আহ্বান একটি মেরুকৃত রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরে। অংশগ্রহণের জন্য সব দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে, তিনি ঐক্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি: ইউনূসের বক্তৃতা একটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। সিস্টেমিক সমস্যাগুলোকে তুলে ধরেছেন তিনি, যা পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোকে দুর্বল করেছে। সংস্কারের উপর ইউনূসের জোর একটি টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা অঙ্গীকারকে তুলে ধরে যা অতীতে রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছিলো।

জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার: স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার উপর ফোকাস সম্ভবত বছরের পর বছর ধরে চলা নির্বাচনী বিতর্ক এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের দ্বারা হতাশ জনগণের মনে আশার আলো জাগিয়ে তোলে।

বক্তব্যের দুর্বল দিক

নির্দিষ্ট সময়সীমার উল্লেখ নেই: ড. ইউনূস যখন বিস্তৃত সংস্কার লক্ষ্যের রূপরেখা দিয়েছেন, যেটি নির্দিষ্ট সময়সীমার অনুপস্থিতি অস্পষ্টতা তৈরি করেছে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের অভিপ্রায়ের প্রতি জনগণের আস্থাকে ক্ষুণ্ন করে।

সংলাপের উপর অপর্যাপ্ত জোর: যদিও তিনি অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, বক্তৃতায় অর্থপূর্ণ সংলাপে স্টেকহোল্ডারদের জড়িত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর অভাব ছিল। রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ তার দৃষ্টিভঙ্গিকে শক্তিশালী করবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিরোধ: বক্তৃতায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানকে যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অবিলম্বে নির্বাচনের দাবি করেছে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এই বিরোধগুলোর জন্য সতর্ক আলোচনা এবং সমঝোতা প্রয়োজন।

জনসাধারণের হতাশা: মূল সংস্কারে বাস্তব অগ্রগতির অভাব জনসাধারণকে সন্দিহান করে তুলেছে। বিশেষ করে যারা সময়মতো নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পেতে আগ্রহী।

জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি: জনসাধারণের অনুভূতিকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য লেখক সেরাজুল আই ভূঁইয়া কর্তৃক পেশাদার, ছাত্র, সুশীল সমাজের সদস্য এবং বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (ইউএসএ) সাধারণ জনগণসহ বিভিন্ন পটভূমির ৫০ জন উত্তরদাতাদের নিয়ে একটি স্ন্যাপ পোল পরিচালিত হয়েছিল। জরিপে ড. ইউনূসের বক্তৃতা এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মতামত নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৫৬ % মানুষ ইউনূসের বক্তৃতাকে সমর্থন জানিয়েছেন। ২৮ % মানুষ কিছুটা হলেও সমর্থন করেছেন। ১২ % মানুষ সংক্ষিপ্তভাবে এই বক্তৃতা শুনেছেন এবং ৪ % এ বিষয়ে সহমত নন। ৩০ % মানুষ একবছরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছেন। ২ বছরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছেন ৫৪% মানুষ । ১৬ % মানুষ চেয়েছেন ৩ বছরের মধ্যে নির্বাচন। এর পাশাপাশি ২৬ % মানুষ চেয়েছেন আগে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার, পরে নির্বাচন। ৭০ % মানুষ চেয়েছেন আগে শুধু প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোই সম্পন্ন করে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। ৪ % মানুষ বলেছেন এখনই নির্বাচনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।    

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

অবস্থান: বিএনপি ধারাবাহিকভাবে বলে আসছে যে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে নির্বাচন জরুরি। প্রাথমিক বিরোধী দল হিসাবে বিএনপি বিশ্বাস করে যে নির্বাচন বিলম্বিত করা শাসনের প্রতি জনগণের আস্থাকে ক্ষুণ্ন করে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে বাড়িয়ে তোলে।

উদ্বেগ: বিএনপি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে সংস্কারের জন্য দীর্ঘ সময়সীমা তাদের রাজনৈতিক প্রভাবকে প্রান্তিক করে দিতে পারে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে তার ক্ষমতা সুসংহত করার সুযোগ করে দেবে। পূর্ববর্তী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দলের অংশগ্রহণের ইতিহাসের কারণে এই ধারণাটি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। বিএনপি নেতারাও আশঙ্কা করছেন যে অতিরিক্ত বিলম্ব নির্বাচনী অনিয়ম মোকাবিলার তাগিদকে হ্রাস করতে পারে এবং তৃণমূলস্তরে  সমর্থন জোগাড় করার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

সুপারিশ: বিএনপির উদ্বেগ মেটাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য স্বচ্ছ এবং সুস্পষ্ট  নির্বাচনী সময়সূচি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি বিএনপিকে আশ্বস্ত করবে যে অন্তর্বর্তী সরকার তার মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে না। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, ভোটার তালিকা আপডেট এবং নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিএনপির আস্থা ফিরতে পারে এবং এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণকে সহজতর করতে পারে।

জামায়াতে ইসলামী

অবস্থান: জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে সংস্কারের পক্ষে কথা বলেছে, তারা জোর দিয়ে বলেছে যে ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়াই নির্বাচনী প্রক্রিয়া সংঘটিত হলে তা আগের মতোই পদ্ধতিগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়াবে। তারা গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার ওপর জোর দিয়েছে।

উদ্বেগ: জামায়াত আশঙ্কা করছে যে একটি দ্রুত নির্বাচন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। ভোটার জালিয়াতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসনের মতো বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে স্থায়ী করতে পারে।  

সুপারিশ: জামায়াতের উদ্বেগ মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্বিদলীয় সংস্কার তদারকি কমিটি গঠনের কথা বিবেচনা করা উচিত। সমস্ত প্রধান রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত এই সংস্থাটি সংস্কারের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে স্বচ্ছতা এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জামায়াতকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে, সরকার আস্থা বৃদ্ধি করতে পারে এবং সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটি ন্যায্য ও সমান খেলার ক্ষেত্র তৈরি করার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করতে পারে।

ছোট দল এবং সুশীল সমাজ

অবস্থান: ছোট রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজ গোষ্ঠী সাধারণত অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডাকে সমর্থন করে। তারা পদ্ধতিগত সংস্কারকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং অনেকেই প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর অ-রাজনৈতিককরণের ওপর ড. ইউনূসের ফোকাসের প্রশংসা করেছেন। তারা বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যার স্বার্থ প্রতিফলিত করার জন্য সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন।

উদ্বেগ: ছোট দলগুলো প্রায়শই নির্বাচনী নীতি তৈরিতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সামনে নিজেদের ক্ষুদ্র বলে মনে করে। এদিকে, সুশীল সমাজের গোষ্ঠীগুলো সংস্কারগুলো স্বচ্ছ এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে যাতে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোর অভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। এই স্টেকহোল্ডাররা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে অর্থপূর্ণ সম্পৃক্ততা না থাকলে, বিস্তৃত রাজনৈতিক আলোচনায় তাদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ বলে মনে হতে  পারে।

সুপারিশ: এই উদ্বেগগুলো মোকাবিলা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিনিধিত্বকে অগ্রাধিকার দেয়া। পরামর্শমূলক ফোরাম প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ছোট দল এবং সুশীল সমাজ সংস্কারের বিষয়ে আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অবদান রাখতে পারে।  এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার বৈধতা বৃদ্ধি পাবে। নির্বাচনী তদারকি কমিটিতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানের ক্ষেত্রে  একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করতে পারে এবং ঐক্যমত্য গড়ে তুলতে পারে।

সমষ্টিগত অন্তর্দৃষ্টি: রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূখণ্ডে নেভিগেট করার জটিলতার দিকটি প্রকাশ করে। যদিও বিএনপি নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা দাবি করে জামায়াত সতর্কতার পরামর্শ দেয় এবং ছোট দলগুলোর অন্তর্ভুক্তির উপর জোর দেয়, তাদের সম্মিলিত উদ্বেগ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং স্বচ্ছতার মানদণ্ড ।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই তার সংস্কার এজেন্ডা মেনে চলার মাধ্যমে এই উদ্বেগগুলোকে মোকাবিলা করে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সক্রিয় যোগাযোগ, দৃশ্যমান অগ্রগতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিনির্ধারণ এই বিভাজনগুলো দূর করে গণতান্ত্রিক লক্ষ্য পুনরুদ্ধারের পথকে প্রশস্ত করতে পারে। গঠনমূলক সংলাপে সকল স্টেকহোল্ডারকে সম্পৃক্ত করে এবং বিশ্বাসযোগ্য সংস্কারের প্রতি তার অঙ্গীকার প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। উত্তরদাতারা ডক্টর ইউনূসের সততা, বৈশ্বিক খ্যাতি এবং সংস্কারের প্রতিশ্রুতির ব্যাপকভাবে প্রশংসা করেছেন। অনেকেই তাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম একজন পরিবর্তনশীল নেতা হিসেবে দেখেন। কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারের গতি নিয়ে অধৈর্যতা প্রকাশ করে বাস্তব অগ্রগতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন।

ঢাকার একজন তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, দেশ অচলাবস্থায় থাকতে পারে না। আমরা যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি তা মোকাবিলায় জনগণের একটি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। যত বিলম্ব হবে তা সাধারণ নাগরিকদের দুর্দশা বাড়াবে।’ একজন সিনিয়র ব্যাংকার পণ্যের দামের ক্রমাগত বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, উল্লেখ করেছেন যে সরকার যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি জনসমর্থন এবং প্রশাসনের প্রতি আস্থা নষ্ট করতে পারে। তিনি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদার দাবিতে আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে অগ্রাধিকারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। একটি নেতৃস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য ইউনূসের আন্তর্জাতিক খ্যাতির কথা তুলে ধরে জোর দিয়ে বলেছেন, ‘তার অবস্থান বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার একটি অনন্য সুযোগ প্রদান করে।’

সামনে এগোনোর লক্ষ্যে কিছু সুপারিশ

একটি টাইমলাইন তৈরি করুন: জনগণের আস্থা বাড়াতে এবং বিলম্বের অভিযোগ এড়াতে সংস্কার ও নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করুন।

আলাপচারিতা বাড়ান: ঐকমত্য তৈরি করতে এবং সংস্কারগুলোতে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নিশ্চিত করতে একটি কাঠামোগত সংলাপে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীসহ সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করুন।

বাস্তব অগ্রগতি প্রদর্শন: নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করার কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করুন।

জনসংযোগ বাড়ান: স্বচ্ছ ও অ্যাক্সেসযোগ্য চ্যানেলের মাধ্যমে সংস্কারের অগ্রগতি সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট সরবরাহ করুন তাতে জনগণের আস্থা বাড়বে। বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তা মানুষকে জানাতে এই মুহূর্তে একজন সক্রিয় ও গতিশীল প্রেস সচিবের প্রয়োজন।

স্বচ্ছতার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার: ভোটার নিবন্ধন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ এবং জনগণের প্রতিক্রিয়া জানতে ডিজিটাল সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করুন।

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করুন: রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্যস্থতা করতে এবং সংস্কার প্রক্রিয়াকে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদানের জন্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থার সন্ধান করুন।

উপদেষ্টাদের রদবদল করুন: জনসাধারণের মধ্যে একটি বিরাজমান ধারণা হল যে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে বেশ কিছু উপদেষ্টা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হলেও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রত্যাশা পূরণ করছেন না। কম পারফরম্যান্সকারী উপদেষ্টাদের প্রতিস্থাপন করে তারুণ্যের ওপর জোর দিন।  

বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত: ইউনূসের ভাষণকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও তার ওপর  তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক চাপ এবং সংস্কারের প্রতিশ্রুতি পালনের গুরু দায়িত্ব রয়েছে। এর সাফল্য নির্ভর করবে কার্যকর বাস্তবায়ন, স্বচ্ছ যোগাযোগ ও  জনবিশ্বাসের উপর। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে নির্বাচন সংঘটিত করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ঐক্যমত ও বাস্তব অগ্রগতি প্রদর্শন করে এবং নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে ইউনূস ও তার প্রশাসন সততার সঙ্গে এই সময়টিকে নেভিগেট করতে পারে। বাংলাদেশ ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। ইউনূসের নেতৃত্ব আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, জবাবদিহিমূলক ও স্থিতিস্থাপক গণতন্ত্র গড়ে তোলার একটি বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা, ধৈর্য ও গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অটল অঙ্গীকার, যা সকল বাংলাদেশিদের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ প্রশস্তকরবে।  

লেখক: অধ্যাপক এবং জর্জিয়ার সাভানা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান। 

সূত্র: দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status