ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবার, ১১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪ রজব ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

তরুণ প্রজন্ম সুরক্ষায় চাই শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন

এবিএম জুবায়ের
১৮ নভেম্বর ২০২৪, সোমবারmzamin

তামাক মৃত্যু ঘটায়। এক প্রজন্মের তামাকসেবী যখন মৃত্যুবরণ করেন কিংবা ঘাতক ব্যাধির কারণে তামাক ছাড়তে বাধ্য হন, তামাক কোম্পানির জন্য তখন নতুন প্রজন্মের তামাকসেবী তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যে কিশোর-কিশোরী আজ ঠোঁটে তামাকপণ্য তুলে নিচ্ছে, কাল সে-ই পরিণত হচ্ছে তামাক কোম্পানির আমৃত্যু ভোক্তায়। কেবল বাংলাদেশেই তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যুতে তামাক কোম্পানিগুলোকে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার  ভোক্তা হারাতে হয়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাই সর্বদা চলে নতুন ভোক্তা তৈরির কাজ। তরুণ প্রজন্মই এক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে ১৩-১৫ বছর বয়সী অন্তত ৩ কোটি ৭০ লাখ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত তামাক ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ বছর বয়সের আগেই যারা তামাকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন তাদের মধ্যে নিকোটিন নির্ভরতা এবং আমৃত্যু তামাক ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৪ অনুযায়ী, প্রায় ৯০ শতাংশ সিগারেট ধূমপায়ী ১৮ বছর বয়সের মধ্যে প্রথমবার ধূমপান করে। খুব অল্প বয়সে তামাকপণ্যে আসক্ত হয়ে পড়লে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। ফুসফুস ক্যান্সার, হৃদরোগ, অকাল বার্ধক্য, মানসিক অস্থিতিশীলতাসহ নানাবিধ রোগ সৃষ্টি হয় তামাকের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, অল্প বয়সে ধূমপানে আসক্তদের মধ্যে অ্যালকোহলে আসক্তির সম্ভাবনা স্বাভাবিকের তুলনায় তিন গুণ, গাঁজায় (মারিজুয়ানা) আট গুণ এবং কোকেনের ক্ষেত্রে ২২ গুণ বেশি। এ ছাড়াও অল্পবয়সে তামাকের ব্যবহার শরীরের কর্মক্ষমতা এবং উদ্দীপনা কমিয়ে দেয়।
তারুণ্যকে আসক্ত করতে সামপ্রতিক সময়ে তামাক কোম্পানিগুলো সাধারণত নিচে উল্লিখিত কূটকৌশলগুলো ব্যবহার করে থাকে:

* মনোমুগ্ধকর সুগন্ধি ব্যবহার: বর্তমানে বাজারে প্রায় ১৬ হাজার সুগন্ধযুক্ত ই-সিগারেট, ভেপিং, সিসা এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য রয়েছে। ফলে শিশুখাদ্য এবং তামাককে আলাদা করতে পারছে না অনেক স্কুলপড়ুয়া। অনেকটা না বুঝেই হাতে তুলে নিচ্ছে এসব ক্ষতিকর পণ্য। 

* আকর্ষণীয় ডিজাইন: ইউএসবি স্টিক, ক্যান্ডি, কলমসহ বিভিন্ন পণ্যের আদলে আকর্ষণীয় ডিজাইনে বাজারজাত করা হচ্ছে ই-সিগারেট ও ভেপিং পণ্য। 

* বিনোদন মাধ্যমগুলোতে তামাক ব্যবহার প্রদর্শন: লচ্চিত্র, টিভি প্রোগ্রাম, সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন স্ট্রিমিং প্রোগ্রামগুলোতে তামাকের চিত্রায়ন বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে তারুণ্যের মনে জায়গা করে নিচ্ছে তামাক কোম্পানি। তামাকপণ্যকে উপস্থাপন করা হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক সৌন্দর্য ও আকর্ষণের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে। 

* ইনফ্লুয়েন্সার ব্যবহার: তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করা হচ্ছে মিডিয়া/সোশ্যাল মিডিয়া আইকন, সেলিব্রেটি/ ইনফ্লুয়েন্সারদের। 

* সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ভেপিংয়ের প্রচারণা: প্রথাগত সিগারেটের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে এসব পণ্য ‘কম ক্ষতিকর’ বা ‘ক্লিনার’ মর্মে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। 

* বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন: শিশু এবং তরুণ শিক্ষার্থীরা যাতে স্বল্পমূল্যে এবং অনায়াসে তামাক ও নিকোটিন পণ্যের নাগাল পায় সেজন্য বিদ্যালয়ের আশপাশে শিশুদের পছন্দের খাবার যেমন- ক্যান্ডি, চিপস, মিষ্টান্ন, নাস্তা খাবার ও কোমল পানীয়র কাছাকাছি তামাক পণ্যগুলো সাজিয়ে রাখা হয় এবং এজন্য বিক্রেতাদের প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি বিপণন সরঞ্জাম এবং প্রদর্শনী বাক্স প্রদান করা হয়।

* অনুষ্ঠান আয়োজন:  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হচ্ছে জব ফেয়ার, ব্যাটল অব মাইন্ডস প্রভৃতি অনুষ্ঠান। বিভিন্ন ফ্রন্ট গ্রুপ এবং করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) কার্যক্রমের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
১৯৮১ সালে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের অভ্যন্তরীণ গোপনীয় এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “আজ যে কিশোর-কিশোরী (টিনএজার), আগামী দিন সে-ই হবে আমাদের নিয়মিত ভোক্তা।” তরুণ প্রজন্মকে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডে আকৃষ্ট করতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করে তামাক কোম্পানিগুলো। তামাক পণ্যের বিপণন ও প্রচার কার্যক্রম যতই বাড়বে, অল্পবয়সী তামাকসেবীর সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে। ২০১৭ সালে আমেরিকায় ই-সিগারেটের বিজ্ঞাপনে মোট ব্যয় হয় ৪৮ মিলিয়ন ডলার, যা এক বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে বেড়ে ১১০ মিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়ে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় অঞ্চলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার ১২.৫ শতাংশ, অথচ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যা ২ শতাংশ। 

টোব্যাকো অ্যাটলাস-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত মোট ১১০টি স্কুলের পারিপার্শ্বিক এলাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, স্কুলগুলোর ১০০-মিটার ব্যাসার্ধ এলাকার ভেতরে প্রায় ৯৭ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে কোনো না কোনো উপায়ে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন এবং ৩৯ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে শিশুদের চোখ বরাবর স্থানে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। ৯৬ শতাংশ দোকানেই চকলেট, ক্যান্ডি, কোমল পানীয় ইত্যাদির পাশেই তামাকপণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে বর্তমান জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশই তরুণ-তরুণী। তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট কীভাবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তামাকে আসক্ত করে ব্যবসা বাড়ানো যায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উচিত তামাক কোম্পানির ছোবল থেকে এদেরকে সুরক্ষা প্রদান করা। তামাক আসক্ত অসুস্থ প্রজন্ম দেশের অগ্রগতির হাতিয়ার না হয়ে বরং সমাজ ও অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তরুণ প্রজন্ম সুরক্ষায় বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্ত, ই-সিগারেটসহ সকল ভ্যাপিং পণ্য নিষিদ্ধ এবং তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা
ইমেইল: [email protected]

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Bangladesh Army

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status