ঢাকা, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২ রজব ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

মামলা ঝুলছেই স্বীকৃতিও মেলেনি, স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের সৈনিকদের কথা

জিয়াউর রহমান সরদার পলাশ

(২ মাস আগে) ১৬ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ৪:২৮ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:১২ পূর্বাহ্ন

mzamin

বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের অপকর্মের প্রতিবাদ করে বহু মানুষ বাড়িছাড়া, দেশছাড়া হয়েছেন। যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনরাও সরকারের রোষানল থেকে বাঁচতে পারেননি। মামলা-হামলায় দুর্বিষহ জীবন কেটেছে প্রতিবাদী মানুষ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের। ফ্যাসিস্ট সরকারের হুমকিধমকি, মামলার আসামি হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাহসী কিছু সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট। বিদেশে গিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করেও তারা অকুতোভয়ে লড়ে গেছেন নিজ দেশের মানুষ ও গণতন্ত্রের মুুক্তির জন্য। তারা প্রতিনিয়ত বিগত সরকারের দুঃশাসনের নানা চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছেন। বিশ্বব্যাপী নানা ফোরামে তুলে ধরেছেন নিপীড়িত বাংলাদেশিদের কথা। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানে তাদের ছিল অবিস্মরণীয় অবদান। ছাত্র-জনতার অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে ১০০ দিন পার করেছে। এখন পর্যন্ত তাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা বা তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় এখনো তারা দেশের মাটিতে পা রাখতে পারছেন না। মেলেনি কোনো স্বীকৃতিও।

জানা গেছে, যেসব সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট বিদেশে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী, পিনাকী ভট্টাচার্য, তাসনীম খলিল, ড. কনক সারোয়ার, জুলকারনাইন সায়ের খান সামি, ইলিয়াস হোসেন, আব্দুর রব ভুট্টো, মনির হায়দার, ফাহাম আবদুস সালাম, শাহেদ আলম,  সাইফুর সাগর, নাজমুস সাকিব, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবসহ আরও অনেকে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এসব প্রতিবাদী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দেওয়া হবে বীরের স্বীকৃতি। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এসব ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিবাদী সাংবাদিকের মধ্যে মুশফিকুল ফজল আনসারীকে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তবে মামলার কারণে অন্যদের দেশে ফেরার পথটাই এখনো উন্মুক্ত হয়নি।

জানা গেছে, প্রবাসী সমালোচকদের স্বজনদের হেনস্তার অভিযোগ গত ১৫ বছরে বারবার সামনে এসেছে। এর জেরে বাংলাদেশে ভিন্নমত দমন করতে অ্যাকটিভিস্ট ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানির অভিযোগ তুলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। পেশায় চিকিৎসক, ফ্রান্সে থাকা মানবাধিকারকর্মী পিনাকী ভট্টাচার্য। তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার বক্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। তার লাখ লাখ অনুসারী রয়েছেন। মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে একের পর এক ভিডিও বক্তব্য হাজির করেছেন জনগণের সামনে। সরকারের নানা অপকর্মের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আর এ কারণে তার বৃদ্ধ মা এবং মামাকে দেশে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে। চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন তারা। জুলাই বিপ্লবের পর বর্তমান সরকারকেও তিনি নানাভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন।

সাংবাদিক ড. কনক সারোয়ার ইউটিউব টকশোয় স্বৈরাচার সরকারের মুখোশ উন্মোচন করে গেছেন। এজন্য তার পরিবারের ওপর অনেক নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু তিনি পিছু হটেননি। সরকারের দুর্নীতি আর অনিয়মের ঘটনা বারবারই সামনে নিয়ে এসেছেন। জানা গেছে, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হয়ে ২০১৫ সালে নয় মাস জেল খাটার পর ২০১৬ সালে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর তার বোন নুসরাত শাহরিনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে তার বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করা হয়। দুই মামলায় নুসরাতকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গ্রেপ্তারের পর প্রায় ছয় মাস কারাগারে থাকার পর ২০২২ সালের ৩০ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে দেশের বাইরে চলে যান নুসরাত। খ্যাতিমান সাংবাদিক তাসনীম খলিল। সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক। গত কয়েক বছরে একের পর এক অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে সরকারের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোশ উন্মোচন করেছেন। কুখ্যাত আয়নাঘরের বিষয়টি নেত্র নিউজই প্রথম সামনে নিয়ে আসে। গুম, ক্রসফায়ার নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে তোলপাড় তৈরি করে সারা দুনিয়ায়। সুইডেনপ্রবাসী এ সাংবাদিকের মাকে ভয়ভীতি দেখানো হয় বারবার।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার চাপে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাংবাদিক মনির হায়দার। যুক্তরাষ্ট্রে বসেও তিনি অনলাইনে দেশের পক্ষে করেছেন অনেক সেমিনার। ছিলেন বিগত সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগেও তার বাসা এবং গাড়িতে হামলা চালানো হয়।

সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়। অনুসন্ধানী এ সাংবাদিক শুরু থেকেই সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। দুর্নীতি আর অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রকাশ করেছেন ভয়ংকর সব তথ্য। প্রকাশ করেছেন বহু গোপন নথি, যা সরকারকে বিপাকে ফেলে। দেশে থাকতে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। দেশ ছাড়ার পর তার বিরুদ্ধে আরও ১২টি মামলা হয়েছে। একটি মামলায় তাকে ছয় মাসের সাজাও দেওয়া হয়। আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রথম আলোচনায় আসেন জুলকারনাইন সায়ের খান সামি। শেখ হাসিনার সমর্থনে জেনারেল আজিজ আহমেদ পরিবার কীভাবে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তা আলোয় আসে ওই রিপোর্টে। এরপর একের পর এক নানা অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের।

সাংবাদিক শাহেদ আলম যুক্তরাষ্ট্র থেকে নানা বিশ্লেষণাত্মক ভিডিও প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝরও পুরোটা সময় সরব ছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের একাধিক দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন।

সাংবাদিক আব্দুর রব ভুট্টো ভিডিওসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সরকারের অপকর্ম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখেন। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য এবং সরকারের মন্ত্রী এমপি দুর্নীতির আর বিদেশে টাকা পাচারের একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এ কারণে তার ছোট ভাই ইউপি সদস্য আব্দুল মুক্তাদির মনূকে গ্রেফতার করে কারাগারারে প্রেরণ করা হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে ছিলো তার পুরো পরিবার।

ইউটিউব চ্যানেল নাগরিক টিভির নাজমুস সাকিবও সরব ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। বিজ্ঞানী ফাহাম আবদুস সালামের ভিডিও বেশ সাড়া ফেলে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁর বক্তব্য বিপুল আবেদন তৈরি করে। ব্লগার আসাদ নূরের বরগুনার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাঁর বাবা-মাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে দুই দিন আটক রাখাসহ অনেক ঘটনা সামনে এসেছে। এই প্রতিবাদী সৈনিকদের কষ্টের জীবনের কথা বাংলাদেশ প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবে।

 

লেখক: ইতালি প্রবাসী

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Bangladesh Army

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status