মত-মতান্তর
বর্ষা বিপ্লব
বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী শাসককে উৎখাত, জার্মানি যেভাবে বিষয়টিকে দেখছে
শাফকাত মুনির
(৪ সপ্তাহ আগে) ১২ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ৪:২৩ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৪:৫৩ অপরাহ্ন
জুলাই মাসে ৩৬ দিনেরও বেশি সময় ধরে বর্ষা বিপ্লব স্থায়ী হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে, আর তা শেষ হয় শাসকের অপসারণের মাধ্যমে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানুয়ারিতে একটি বিতর্কিত নির্বাচনে জিতেছিলেন, সেই নিবাচনে বিরোধী দল ও সুশীল সমাজ কার্যত নীরব ছিল। তখন অনেকেই কল্পনা করতে পারেননি যে শেখ হাসিনাকে শিগগিরই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। তবুও বাংলাদেশের অনেকের কাছেই বিষয়টি খুব একটা আশ্চর্যজনক ছিল না, কারণ এত বড় জনসংখ্যাকে এতদিন দমিয়ে রাখা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা এখন ভারতে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি তিনি। বাংলাদেশে তার স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন অসম্ভব, কারণ একাধিক খুনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। হাসিনা সরকারের সদিচ্ছার অভাবে ৩৬ দিনের বর্ষা বিপ্লবের সময় ১ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়েছে যাতে হাসিনা বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। তার অনুগতরা হয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বা গ্রেফতার হচ্ছে।
বর্ষা বিপ্লবের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। তবে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হলো-দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতা দমন ও শাসনের বর্বরতা। মন্থর অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধির কারণে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। মধ্যবিত্ত ভুক্তভোগী মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করে সরকারের অপব্যবহার, তহবিল তছরুপ এবং দুর্নীতি প্রসঙ্গে সরব হতে শুরু করেন। এর মধ্যে ঘৃতাহুতির কাজ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা। সরকারের আশ্বাস ও ঘোষণা সত্ত্বেও দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার মোকাবিলায় কোনো সুনির্দিষ্ট কাজ হয়নি। মানুষও আয়নাঘরের (যেখানে বন্দিদের রাখা হতো ভয়ঙ্করভাবে) মতো গোপন কারাগারের কথা জানতে পেরে কর্তৃত্ববাদী সরকারের ওপর ক্রমেই ক্ষুব্ধ হতে শুরু করে। যে সুশীল সমাজ এক সময়ের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্থানের স্তম্ভ ছিল তাকে একাধিকবার অপমানের শিকার হতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে চলেছে নীরব নির্যাতন।
পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে পরিণতির ভয়ে আমিও হয়তো এই লেখা লিখতে পারতাম না। এক সময় মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে এসেছেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। বাংলাদেশের বর্ষা বিপ্লব প্রথম সফল জেনারেশন জেড বিপ্লব। এর নেতৃত্বে ছিলেন শিক্ষার্থীরা যারা সহিংসতার মুখে নত হতে অস্বীকার করেছিল। এই তরুণদের ত্যাগের চেতনা শেষ পর্যন্ত প্রবীণদের রাস্তায় নেমে আসতে উদ্বুদ্ধ করে।
বাংলাদেশের জেনারেশন জেড দেখিয়েছে প্রযুক্তি কীভাবে একটি বিপ্লবে চূড়ান্ত ভূমিকা নিতে পারে। সরকার যখন এক সপ্তাহের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিলো, তখন বিক্ষোভকারীরা ব্লুটুথের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ জারি রেখেছিলো। সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্টফোন সরকারের বিরোধিতা করার শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। বিক্ষোভ শুধু নৃশংস শাসকের বিরুদ্ধে ছিল না। রাজধানী ঢাকাতেও শিল্প, গ্রাফিতি ও সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রতিবাদ সংঘটিত হতে দেখা গেছে। হাজার হাজার তরুণ দেশাত্মবোধক বাংলা গান গাইছে এমন দৃশ্যও আজ সবার মনে গেঁথে আছে। বিপ্লব দেখিয়েছিল যে, সরকার যতই বল প্রয়োগ করুক না কেন, যখন জনগণ একত্রিত হয় তখন তাদের কেউ পরাজিত করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সব কর্তৃত্ববাদীদের অবশ্যই জনগণের ইচ্ছার কাছে মাথা নত করতে হবে, এমনকি তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলো জার্মানি। শুধুমাত্র বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যই নয় বরং দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথেও জার্মানির ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কারে জার্মানের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানি মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের মতো মূল্যবোধের প্রচার করে, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বৈত ভূমিকা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক কারণ, কর্তৃত্ববাদকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য আগের সরকার সবসময় গণতন্ত্রের পরিপন্থী ছিল। এই দ্বৈত ভূমিকা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ কর্তৃত্ববাদকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য পূর্বতন সরকার সবসময় মানুষকে বুঝিয়ে এসেছে কম গণতন্ত্র মানেই বেশি উন্নয়ন। বিপ্লব মানুষকে জাগ্রত করেছে, গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে কাজটি কঠিন।
বর্তমান সরকারকে তিনটি অগ্রাধিকারের উপর ফোকাস করতে হবে। সেগুলো হলো-নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, স্থানীয় দুর্নীতির অবসান। নিরাপত্তা খাতে সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করা, যার মধ্যে পুলিশ ও নিরাপত্তার প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা আবশ্যক। ১৬ বছরের দমন-পীড়নের পর অবশেষে বাংলাদেশি জনগণ কথা বলতে শুরু করেছে। অধিকার রক্ষা করার পাশাপাশি আমাদের সবার জন্য স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সহানুভূতি নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রতিক অনেক বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে; বর্ষা বিপ্লব যাতে একটি সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে তার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো।
বস্তাপচা চর্বিত চর্বনকে টেনে টেনে লম্বা করার সাথে জার্মান নামের ব্র্যানডিং জুড়ে দিয়ে একটা গদ্যা লিখে ছেড়ে দিল । নেও এখন খাও এই মহা মূল্যাবান বস্তু ।