শেষের পাতা
সিলেটে খতিয়ান প্রেসে দুর্নীতি করে কোটিপতি লিটন
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
৯ নভেম্বর ২০২৪, শনিবারঢাকার বাইরে সেটেলমেন্ট ‘মিনি প্রেস’ একমাত্র সিলেটে রয়েছে। এই প্রেসে সিলেটের জমির খতিয়ান পর্চা ছাপানো হয়। আর প্রেসকে ঘিরে সিলেটে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। শেষ মুহূর্তে টাকার বিনিময়ে জমির মালিকানা পরিবর্তনের অভিযোগ রয়েছে প্রেস পরিচালনার দায়িত্বে থাকা গোলাম মোস্তফা লিটনের বিরুদ্ধে। তিনি নিজে উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার হলেও পড়ে আছেন প্রেসের দায়িত্ববান ব্যক্তি হিসেবে। লিটনকে ঘিরে নানা গুঞ্জন সিলেটে। দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।
সিলেট নগরে কিনেছেন ফ্ল্যাটবাড়ি। হবিগঞ্জের মাধবপুরে রয়েছে নামে-বেনামে অনেক সম্পদ। অথচ এই লিটন এক সময় ছিলেন নিতান্ত গরিব পরিবারের সন্তান। হবিগঞ্জের মাধবপুরের আন্দিউড়া গ্রামের বাসিন্দা লিটন সেটেলমেন্টের ড্রাফটসম্যান পদে ১৯৯৪ সালে ময়মনসিংহ সেটেলমেন্ট জোনে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ২০০৮ সালে সিলেট সেটেলমেন্টে তার বদলি হয়। তবে দীর্ঘ ১৮ বছর সিলেট সেটেলমেন্টে কখনো তাকে মূল পদ ড্রাফ্টসম্যান পদে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। তিনি রেকর্ড পরিবর্তন, ভূমি দালালি ও তদবির বাণিজ্য নিয়ে বেশি ব্যস্ত।
সিলেট সেটেলমেন্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ঢাকার বাইরে সিলেটে একমাত্র প্রেস স্থাপনের পর গোলাম মোস্তফা লিটন সিলেট সেটেলমেন্টে যোগদান করেই প্রেসের সার্বিক দায়িত্বভার নেন। মাঠ জরিপ থেকে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই পর্যন্ত কাজ সমাপ্ত করে মৌজা রেকর্ডপত্র চূড়ান্তভাবে মুদ্রণের জন্য সিলেট প্রেসে জমা হয়। জমাকৃত মৌজার প্রকৃত রেকর্ডীয় ভূমির মালিকদের অজান্তে লিটন অবৈধভাবে গোপনে অসংখ্য খতিয়ানের মালিকানা, অংশ, দাগ, ভূমির শ্রেণি ও এরিয়া বদলে দিয়ে রেকর্ড মুদ্রণ, চূড়ান্ত প্রকাশনা করে নেন। লাগামহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসহায় ভূমির মালিকদের নির্ভেজাল ভূমির রেকর্ড অবৈধ পন্থায় পরিবর্তন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের সিন্ডিকেটের একজন সক্রিয় সদস্য হওয়ার সুবাদে রেকর্ড পরিবর্তন করার মূল কারিগর তিনি। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন- হবিগঞ্জ সদর উপজেলার অলিপুর মৌজায় মাঠ জরিপে প্রস্তুতকৃত ৬১৫ নং খতিয়ানে ভূমির মালিকের নামে চারটি দাগ রেকর্ড করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ওই খতিয়ানে কোনো মামলা ছাড়াই আরও ৪১টি দাগ বিভিন্ন খতিয়ান থেকে কর্তন করে মোট ৪৫টি দাগ সৃজন করে উৎকোচ বাবদ হাতিয়ে নেন কয়েক কোটি টাকা। এ ছাড়া মাধবপুর সেটেলমেন্ট অফিস থেকে ২০১৮ সালে কাটিয়ারা ও করডা মৌজার রেকর্ডপত্র দু’টি মুদ্রণের জন্য সিলেট প্রেসে জমা হলেও চূড়ান্তভাবে প্রকাশনার কাজ সমাপ্ত না করে অবৈধভাবে রেকর্ড পরিবর্তনের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। অথচ মৌজা দু’টির মধ্যদিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভূমি অধিগ্রহণে সরকারি সুবিধার প্রয়োজনে চূড়ান্ত প্রকাশনার কাজ অতি দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করার তাগিদ থাকলেও তিনি সেটি করছেন না। এখানে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশনা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। সিলেট সেটেলমেন্টের অত্যন্ত ভয়ঙ্কর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা লিটনের অপকর্মেরও কোনো জবাবদিহিতা নেই। তিনি ম্যানেজে পটু হওয়ায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সবাইকে ম্যানেজ করে চলেন।
সিলেটে চাকরিরত অবস্থায়ই তার বিরুদ্ধে তদন্ত এলেও টাকা দিয়ে সব তদন্তই পক্ষে নিয়ে নেন। সিলেট সদর উপজেলার ৪৫ নং জে এল ভুক্ত ছালিয়া মৌজার ৭৪১ নং ডিপি খতিয়ানের হাল ২০০৩, ২০০৪, ২০১৭ ও ২০১৮ নং দাগে ৫ দশমিক ৭৫ একর ভূমি মনোয়ার বখত মজুমদার এবং ১৬২০ নং ডিপি খতিয়ানে ২০০২ নং হাল দাগে ৬ দশমিক ২২ একর ভূমি দেওয়ান ছাকিয়া রাজা চৌধুরীর নামে বর্তমান জরিপ থেকে চূড়ান্ত স্তর পর্যন্ত রেকর্ড বহাল থাকলেও দু’টি খতিয়ানের সম্পূর্ণ ভূমি অবৈধ পন্থায় পরিবর্তন করে ১৬২০ নং ডি.পি খতিয়ানের মালিকের নাম কর্তন করে অন্যের নামে দেয়া হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ৩৮ নং জেএলভুক্ত গোলামীপুর মৌজার হাল ৮০, ৯৬, ১০১, ১০৩, ১০৬ ও ১৩৬ নং দাগের ১ দশমিক ১১ একর ভূমি ১৯ নং ডিপি খতিয়ানের মালিক আব্দুর রহিম তালুকদারের নাম কর্তন করে একই ডিপি খতিয়ানে ফরহাদ চৌধুরীর নামে রেকর্ড পরিবর্তন করে মৌজাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার ২০ নং জেএল ভুক্ত মাদারগড়া মৌজায় ২১৪ নং ডি.পি খতিয়ানে একটি দাগ নিয়ে জনৈক এক ব্যক্তির নামে খতিয়ান সৃষ্টি হয়। পরে ৩১ ধারার আপিল মামলায় এ দাগটি কর্তন করা হলে খতিয়ানটি ছুট বা বাতিল করা হয়। অথচ লিটন বাতিলকৃত ২১৪ নং ডি.পি খতিয়ানে ৬ নং ডি.পি খতিয়ান থেকে হাল ৩০৮ দাগে ১৫ একর, ১৭০ নং খতিয়ান থেকে হাল ১৫৬ নং দাগে ২৮ একর ১৯৭ নং ডি.পি খতিয়ান থেকে হাল ৬৩৩ নং দাগে ১০ একর, ২৭৮ নং ডি.পি খতিয়ান থেকে হাল ২৭৫ নং দাগে ৩২ একর ভূমি কর্তন করে নৃপতি রঞ্জন দাস নামে একজনের নামে রেকর্ড করেছেন। পরে তারা এ নিয়ে আপত্তি তুলেন।
সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে মিনি প্রেসটি স্থাপনের পর থেকে দুর্নীতির খবর খোদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমানের নজরে এলে প্রেসটি ঢাকা সেটেলমেন্ট প্রেসে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেন। পরে অবশ্য সিলেটের এক মন্ত্রীর বাধায় প্রেস ঢাকায় যায়নি। আর এতে ভূমিকা রাখেন লিটন নিজেই। সিলেট সেটেলমেন্টের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন- লিটনের রয়েছে নামে-বেনামে একাধিক বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, নগদ অর্থ, ঢাকা ও সিলেট নগরের রহিম টাওয়ারে আলিশান ফ্ল্যাট ও প্লট। নিজ উপজেলার মাধবপুর বাজারে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ও ফ্ল্যাট করেছেন। আন্দিউড়া নিজ গ্রামের বাড়িতে প্রায় ৪০-৪৫ বিঘা জমির উপর মৎস্য ও গবাদি পশুপাখির খামার রয়েছে। উপজেলার কাটিয়ারা, করড়া, আন্দিউড়া, জগদীশপুর, রতনপুর, বেজুড়া, বেলঘর, ইটাখোলা, মাদারগড়া ও অলিপুরসহ বিভিন্ন মৌজায় একাধিক বাণিজ্যিক ও কৃষি জমির শতকোটি টাকার মালিক তিনি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনায় মাধবপুর বাজার থেকে অলিপুর গেইট পর্যন্ত মহাসড়কের উভয় পাশে ভূমি অধিগ্রহণের ভূমি কর্মকর্তাদের টিমের প্রভাবশালী কর্মকর্তা লিটন। নিজ এলাকা হওয়ায় শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে অধিগ্রহণের আগেই ভূমি মালিকদের কাছ থেকে লুটে নিচ্ছেন টাকা। এ ব্যাপারে উপ-সহকারী কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা লিটন মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সিলেটে তার কোনো ফ্ল্যাট নেই। রহিম টাওয়ারে তিনি ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলো ভুয়া ও ভিত্তিহীন। হবিগঞ্জের কোনো মৌজার ভূমি অধিগ্রহণের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে জানান। এ কারণে ওইসব মৌজার শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। কাটিয়ারা ও করডা মৌজার সব প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন সেটি প্রিন্টের অপেক্ষায় রয়েছে।