ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

শরীর ও মন

ব্যথার সাতকাহন

ডা. মো. বখতিয়ার
৩ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার

ব্যথার  নানা ধরন: মানুষের দেহে বিভিন্ন ধরনের ব্যথা হয়ে থাকে। আমি এগুলোকে মোটাদাগে দু’ভাগে ভাগ করতে চাই। একটা হলো মানসিক কারণ, আরেকটি হলো শারীরিক কারণ। এই লেখায় মূলত শারীরিক কারণ নিয়েই বিস্তারিত লিখতে চাই। শেষে মানসিক কারণও থাকবে।

শারীরিক ব্যথার  বিভিন্ন ধরন: ব্যথা হয় মূলত চার ধরনের। যেমন-
১. মাস্কুলো-স্কেলেটাল পেইন (মাংসপেশি-হাড়ের ব্যথা)।
২. ভিসেরাল পেইন (শাগ্ররীরের ভেতরের নরম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যথা)।
৩. নিউরোপেথিক পেইন (স্নায়ুজনিত ব্যথা)।
৪. ভাস্কুলার পেইন/ ইসকেমিক পেইন (রক্ত চলাচলে বাধগ্রস্ত হওয়ার দরুন ব্যথা)। 
এ ছাড়াও আরেকটি ব্যথা রক্তনালি/ভাস্কুলার রোগের ব্যথা বা ইনফার্কশনের ব্যথা। মূলত সবচেয়ে মারাত্মক ব্যথা হলো এই ইনফার্কশন বা টিস্যু পচনের ব্যথা। আরও কিছু ব্যথা আছে, যেমন- দাঁতের ব্যথা, কানের ব্যথা, চোখের ব্যথা ইত্যাদি। আজকের আলোচনায় প্রধান তিন ব্যথা ছাড়াও অন্যান্যগুলো স্বল্প পরিসরে বলার চেষ্টা করবো।
ব্যথার ওষুধ প্রধানত তিন ধরনের।

যেমন-
১. সেন্ট্রালি এক্টিং: (ব্রেইন বা স্পাইনাল কর্ডে ব্যথার সংবেদনশীলতা বন্ধ করে। এদেরকে বলে অপিওয়েড। যেমন- মরফিন, পেথিডিন, ন্যালবিউফিন, ট্রামাডল ইত্যাদি)।
২. লোকালি অ্যাক্টিং: (যেখানে ব্যথা-শুধু সেখানেই কাজ করবে। যেমন- ঘঝঅওউ, ইবশষপভবহ, ঞরবসড়হরঁস, ঐুংড়সরফব)।
৩. পেইন মোডিফাইং এজেন্ট: (এরা ব্যথার মাত্রা বদলে দেবে বা কমিয়ে দেবে। যেমন- এমিট্রিপ্টাইলিন, সার্টালিন, ডায়াজেপাম, ডুলোক্সেটিন ইত্যাদি)।
এখন শুরুতেই আসা যাক।

১. মাস্কুলো-স্কেলেটাল পেইন: এটা মূলত হাড় এবং মাংসপেশির ব্যথা। এটা হয় মূলত আঘাতজনিত কারণে। এই আঘাতের ধরন বিভিন্ন হতে পারে। যেমন- সরাসরি আঘাত অর্থাৎ রোড ট্রাফিক এক্সিডেন্ট বা মারামারির ফলে (ট্রমা) হতে পারে। আবার কোনো কাজ করতে গিয়ে মাসলে চাপ/টান পড়তে পারে। যাকে বলে মাসল স্ট্রেইন। যেমন- ভারী কিছু উঁচু করতে গিয়ে কোমড়ের মাংসপেশি বা বুকের মাংসপেশিতে টান লাগা ইত্যাদি। এই সব ক্ষেত্রে মূলত ব্যবহার হয় কিছু ব্যথার ওষুধ আর তার সঙ্গে মাংসপেশি নরম করার ওষুধ। কারণ যে মাংসে আঘাত বা টান লাগে তা শক্ত হয়ে যায় এবং তার পাশ দিয়ে চলা নার্ভের ওপর চাপ দেয়। তাই একে নরম করতে হয়। এই ব্যথাটা মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে। নড়াচড়া করলেই ব্যথা বাড়তে পারে। অনেক সময় ব্যথা কিছুক্ষণ থেকে থেকে আসতে পারে, অনেক সময় অনবরত ব্যথা থেকে যেতে পারে।

সাধারণত কী ধরনের ব্যথার ওষুধ  চিকিৎসকরা দিয়ে থাকেন
ঘঝঅওউ (নন-স্টেরয়ডাল এন্টি-ইনফ্লামাটরি ড্রাগ)। খুবই পরিচিত এবং প্রচলিত ওষুধ কিটোরোলাক, ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক, ইন্ডোমেথাসিন ইত্যাদি। এগুলোর সাইড ইফেক্ট হলো এরা এসিডিটি বা বুক জ্বালা করে। তাই এরসঙ্গে গ্যাসের ওষুধ দিতে হয়। বর্তমানে আরেক ধরনের ওষুধও আছে যাদেরকে বলে কক্স-২ ইনহিবিটর। যেমন- ইটোরিকক্সিব, সেলেকক্সিব। এদের সাইড ইফেক্ট কম। এজমার রোগীদের দেয়া যায়। ব্লিডিং টেন্ডেন্সিও কম করে। যাই হোক, এরসঙ্গে যে মাংসপেশি নরম করার ওষুধের কথা বলছিলাম। তা হলো- স্কেলেটাল মাসল রিল্যাক্সান্ট। যেমন- বেক্লোফেন বা টলপেরিসন ইত্যাদি। বাচ্চাদেরকে আইবুপ্রফেন দেয়া হয়।
বয়স্কদের যাদের কিডনীর অবস্থা ভালো না, পাকস্থলীর অবস্থাও মোটামুটি তাদের ক্ষেত্রে নিরাপদ হলো প্যারাসিটামল। অনেকেই ভুলে যান যে, প্যারাসিটামল কিন্তু একটি ব্যথার ওষুধ। সে ক্ষেত্রে দুইটা করে ট্যাবলেট দিনে চার বেলা পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে। এমন কী অন্যান্য ব্যথার ওষুধের সঙ্গেও এটা দেয়া যায়। একে বলে সিনারজিস্টিক ইফেক্ট। অর্থাৎ ব্যথার ওষুধের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। এরসঙ্গে মাংশপেশি নরম করতে এবং ব্যথা কমাতে আরও কিছু ওষুধের প্রভাব আছে। যেমন- ডায়াজেপাম, এমিট্রিপ্টাইলিন। এগুলোকে বলে পেইন মোডিফাইং এজেন্ট।

হাঁটু ব্যথা-
মাস্কুলো স্কেলেটাল পেইনের মধ্যে হাঁটু ব্যথা একটা খুবই পরিচিত সমস্যা। এর কারণ অনুসন্ধান করে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে খুবই পরিচিত কারণ হলো অস্টিওআর্র্থ্রারাইটিস। এসব ক্ষেত্রে উপরোক্ত ব্যথার ওষুধের সঙ্গে স্টেরয়েডের একটা ভূমিকা আছে। ডেফ্লাজাকর্ট, প্রেডনিসোলন ব্যবহৃত হয়। এর পাশাপাশি গ্লুকোসামাইন, ডায়াসেরিন, কন্ড্রয়টিন ব্যবহার হয়। এগুলো হাড়ের উপরের নরম হাড় (কার্টিলেজ) তৈরিতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও হাঁটুর মধ্যে স্টেরয়েড বা হায়ালুরোনেট (হায়ালুরোনিক এসিড) জেল ইঞ্জেকশন দেয়া হয়।

২. ভিসেরাল পেইন: শরীরের হাড্ডি-মাংস বাদে ভেতরের যত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশেষ করে নরম কোষের তৈরি তাদের সবাইকেই বলে ভিসেরা। যেমন- পাকস্তানি, পেটের সমস্ত নাড়িভুঁড়ি, লিভার, পিত্তথলি, কিডনি, প্যানক্রিয়াস, ফুসফুস, হার্ট, রক্তনালি, মূত্রনালি, মূত্রথলি, মেয়েদের জরায়ু, অভারি, অভারিয়ান নালি ইত্যাদি। এমনকি গলার ভেতরের গলবিল, স্বরযন্ত্র ইত্যাদি।
তবে আরও সুক্ষ্মভাবে ভিসেরাল পেইন বলতে বুঝায় যেসব জায়গা নালির মতো এবং ফাঁপা-সে অঙ্গগুলোর ব্যথা। যেমন-পুরো পরিপাকতন্ত্র, পিত্তথলি, মূত্রথলি, এপেন্ডিক্স, জরায়ু, জরায়ু নালি। এই সব জায়গার ব্যথা হলে ব্যথাটা হঠাৎ করে আসে, খামচে ধরার মতো ব্যথা হয় আবার কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়। তারপর আবার আসে। এভাবে চলতে থাকে। এদেরকে বলে কলিকি পেইন। এটা হয় মূলত ইনফেকশন, বা আলসারের জন্য। প্রেগনেন্সির সময়ও মাঝে মাঝে এমন ব্যথা হয়ে থাকে। যাদের অভারিতে বা ফেলোপিয়ান টিউবে ইনফেকশন হয় তাদেরও এরকম ব্যথা হতে পারে।  

এদের ক্ষেত্রে কী ওষুধ?
এসব ব্যথার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ভিসেরাল মাসল রিলাক্স্যন্ট। অর্থাৎ নরম মাংসগুলোকে রিল্যাক্স করার ওষুধ। খুব বহুল প্রচলিত ওষুধ হলো-টাইমোনিয়াম, হাইওসিন বুটাইল ব্রোমাইড, অক্সিফেনোনিয়াম ইত্যাদি। এদের প্রথম ডোজটা ডাবল ডোজ দিয়ে শুরু করলে দ্রুত ব্যথা কমে আসে। তবে এদের একটা পরিচিত সাইড ইফেক্ট হল পায়খানা কষা করে দেয়। তাই ডায়াগনসিস সঠিক হতে হবে।
পেপটিক আলসারের ক্ষেত্রে ঘঝঅওউ সাধারণত দেয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে আরেক ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় এদেরকে বলে সেন্ট্রালি অ্যাক্টিং এজেন্ট। উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- মরফিন, পেথিডিন, ন্যালবিউফিন, ট্রামাডল, টাপেন্টডল ইত্যাদি। পেথিডিন বা নালবিউফিন খুবই শক্তিশালী ব্যথানাশক ওষুধ। দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথা কমে যায়। তবে এর একটা সাইড ইফেক্ট হলো প্রচণ্ড বমি ভাব হয়। তাই এরসঙ্গে বমির ইঞ্জেকশন দেয়া হয়। আরেকটা সাইড ইফেক্ট হলো রোগী ঘুমিয়ে যায় এবং অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়। তাই দেয়ার আগে অবশ্যই শ্বাসকষ্টের রোগীকে না দেয়ায়ই ভালো।
পেটের ব্যথা হলে ডায়াগনসিস কনফার্ম হলে ইনফেকশন জনিত হলে সঙ্গে এন্টিবায়োটিক দিতে হবে। ইনফকশন না থাকলে অহেতুক এন্টিবায়োটিক দেওয়া সমীচীন নয়।

৩. নিউরোপ্যাথিক পেইন: স্নায়ুজনিত ব্যথা। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ে বা সারা গা-হাত-পায়ে জ্বালা পোড়া করে, খোচায়, ঝিন ঝিন করে। এগুলোকে বলে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি। আবার যাদের লো ব্যাক পেইন বা কোমড় ব্যথা থাকে। যেমন- কোমড়ের ডিস্ক সরে যাওয়া বা প্রোলাপ্সের জন্য যে ব্যথা হয়, তা অনেক সময় উরুর পেছন দিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। একে বলে রেডিকুলোপ্যাথি। এদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়- প্রিগাবালিন,  গাবাপেন্টিন। এরসঙ্গে এমিট্রিপ্টাইলিন, ডায়াজেপাম ইত্যাদি দেয়া হয়। তবে এর মূল চিকিৎসা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ বা ডিস্কের সঠিক চিকিৎসা। ফিজিওথেরাপি নেয়া।
৪. ভাস্কুলার/ইস্কেমিক পেইন: রক্তনালির ব্লকজনিত ব্যথা বা ইনফার্কশনের ব্যথা। হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা। পৃথিবীর সবচেয়ে তীব্র ব্যথা হয় এটা। এই ব্যথা কোনো ব্যথার ওষুধ দিয়ে কমতে চায় না। তবে মরফিন বা পেথিডিন দেওয়া হয়। এর মূল চিকিৎসা হলো রক্তনালির ব্লক গলানো। তাহলেই ব্যথা চলে যাবে। এর জন্য স্ট্রেপ্টোকাইনেজ বা হেপারিন ব্যবহার হয় হাসপাতালে।
পায়ের রক্তনালির ব্লক হলে সেই ব্লক অপসারণ করতে হয় অপারেশন করে। যদি অল্প মাত্রায় ব্লক হয়। যেমন- সিগারেট স্মোকারদের বা ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ে ব্যথা হয়। এসব ক্ষেত্রে সিলোস্টাজল, প্যন্টোক্সিফাইলিন, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি-৬, বি-১২ ইত্যাদি দেয়া হয়। তার সঙ্গে মাংসপেশি নরম করা ওষুধ। প্যারাসিটামল দেয়া যেতে পারে।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক 
খাজা বদরুদজোদা মডার্ন হাসপাতাল, সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।

শরীর ও মন থেকে আরও পড়ুন

   

শরীর ও মন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status