ঢাকা, ১৯ মে ২০২৪, রবিবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

সিপিডি’র আলোচনা

দীর্ঘমেয়াদি সংকট, সহজে মুক্তি নেই

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৫ জুলাই ২০২২, সোমবার
mzamin

দেশে চলমান সংকট স্বল্পমেয়াদি নয় উল্লেখ করে সিপিডি আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন- এই সংকট থেকে সহজে মুক্তি মিলবে না। ধানমণ্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ?’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকরা অংশ নেন। এতে মূল প্রবন্ধে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। সরকারের বর্তমান সংকট মোকাবিলার ব্যবস্থাগুলো বেশির ভাগই স্বল্পমেয়াদি প্রকৃতির। তাই সহজে সংকট থেকে মুক্তি মিলবে না। কার্যকরী পদক্ষেপ খুঁজে বের করতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মুদ্রাস্ফীতি ব্যবস্থাপনা, বর্ধিত রাজস্ব উৎপাদন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বৃদ্ধি করা। 
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানে সামষ্টিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম, ব্যাংকিং খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বহিঃখাত নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন সিপিডি’র বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

 এ ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বক্তব্য দেন। 
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সংকট স্বল্পমেয়াদি প্রকৃতির নয়। সহজে সংকট থেকে মুক্তি মিলবে না। বাংলাদেশ মাঝারি মেয়াদির সংকটে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন
বর্তমান ব্যবস্থা অপ্রতুল। তাই স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি উভয় ধরনের ব্যবস্থা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, সংকট সহজ হতে পারে, যদি স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদের পরিকল্পনা নেয়া যায়। সরকারের বর্তমান ব্যবস্থাগুলো বেশির ভাগই স্বল্পমেয়াদি প্রকৃতির। বর্তমানে মধ্যমেয়াদে ম্যাক্রো স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। কঠোর ব্যবস্থার কার্যকরী উপকরণ খুঁজে বের করতে হবে, যা ম্যাক্রো স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। বিশ্বব্যাপী মাঝারি মেয়াদের জ্বালানি সংকট রয়েছে এমন মন্তব্য করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিশ্বব্যাপী মাঝারি মেয়াদের জ্বালানি সংকট রয়েছে। এটি অব্যাহত থাকতে পারে অনেকদিন। 

বাংলাদেশ অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেল এবং এলএনজি জ্বালানি আমদানিতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং দ্বিপক্ষীয় উৎস যেমন; সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতার থেকে ঋণ নিতে পারে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় আমাদের শুধুমাত্র আমদানি করা এলএনজি’র ওপর নির্ভর করা কঠিন হবে। অভ্যন্তরীণ শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। অবিলম্বে পুরনো গ্যাস অনুসন্ধান সাইটগুলোতে গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যবস্থা প্রয়োজন। সরকারকে উপলব্ধি করা উচিত যে, নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমান জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক শক্তি সংকটে শক্তি বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নিত্য প্রয়োজনীয় এমন অনেক খাদ্যপণ্য রয়েছে যার দাম বৃদ্ধি ৫০ শতাংশের বেশি। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর আরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্করণ, রাজস্ব আহরণ ও ঋণখেলাপির দিকে আরও নজর দিতে হবে সরকারকে। তিনি বলেন, বর্তমান সংকট স্বল্পমেয়াদি নয়, মধ্যমমেয়াদি। এভাবে চললে দেশ দীর্ঘমেয়াদি সংকটের দিকে যাবে। 
ব্যাংকিং খাত অত্যন্ত নাজুক: বর্তমান অবস্থায় ব্যাংকিংখাত অত্যন্ত নাজুক বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বলেন, ঋণের সুদের সীমা নির্ধারণ করাই বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ সংকুচিত হয়েছে। জুলাই থেকে মে মাসে বেসরকারি ক্ষেত্রে মাত্র ১২ শতাংশ ঋণ গেছে। যেখানে সরকারের কাছে গেছে ২৭ শতাংশের বেশি। তাই ঋণের সুদের সীমারেখা বেঁধে দেয়া কতোটুকু যৌক্তিক তা বিবেচনা করা দরকার। মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমদানি অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু এটা প্রকৃত আমদানি না। 

পরিমাণের দিক থেকে বাড়েনি। অর্থের দিক থেকে বেড়েছে। এই আমদানি কতোটুকু জেনুইন তাও বিবেচনার বিষয়। কারণ অর্থ পাচার সিংহভাগ ট্রেডের মাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমদানি যেভাবে বাড়ছে রপ্তানি হিসেবে বাড়ছে না, রেমিট্যান্সও বাড়ছে না। আড়াই শতাংশ দিয়ে কতোটুকু কার্যকর হচ্ছে তাও দেখতে হবে। কারণ রেমিট্যান্স বাড়লে ডলারের সংকট কিছুটা কমবে। তাই রেমিট্যান্স আরও বাড়াতে মার্কেট ডাইভারসিফিকেশনের পরিকল্পনা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সব মিলিয়ে দেশে সামষ্টিক পরিবেশ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তার সমাধানে জনগণকেও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। 

ব্যাংক খাতের সংকট ভুল নীতির কারণে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে দারিদ্র্যের সঙ্গে যোগ হলো বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেও আমাদের দেশের যে বাজারব্যবস্থা, মাইক্রো লেভেলে তো অবস্থা আরও খারাপ। শ্রীলঙ্কায় সামষ্টিকভাবে অবস্থা হয়তো খারাপ, তবে মাইক্রো লেভেলে ভালো রয়েছে। ব্যাংক খাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ খাতে সংস্কার না করে সেখানে পরিচালনা পর্ষদে সংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যাংকের সংখ্যা বাড়িয়ে সংকট বাড়ানো হয়েছে। ভুল নীতির প্রভাবেই এমনটা হয়েছে। অর্থ পাচার রোধ, খেলাপি ঋণ আদায় ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে যেকোনো সিদ্ধান্তে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো উচিত। 

অর্থনীতিতে অবিচারের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে:তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতি সংকটে রয়েছে। তবে এ মুহূর্তের সংকট শুধু সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা নয়। ব্যাষ্টিক অর্থনীতিতে একটা অবিচারের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব এখন অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হিসেবে কাজ করছে। এর শিকার হচ্ছে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। তিনি বলেন, সুস্পষ্ট অবিচারের চেহারায় নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা নানানভাবে ব্যাহত হচ্ছে। 

এ ছাড়া সরকার যে ধরনের অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে এগোচ্ছে তাতে যুব বেকারত্ব বাড়ছে। এ রকম অবস্থায় প্রশাসনের যদি সার্বিক উন্নতি না হয় তাহলে অবিচারের নতুন দিক সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতিতে লৌহ ত্রিভুজ গেড়ে বসেছে। এই লৌহ ত্রিভুজ হলো- একমাত্রিক উন্নয়ন দর্শন, স্বার্থের দ্বন্দ্বভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতি বা ব্যবস্থাপনা এবং সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এক ধরনের অবিচার। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট অবিচারের চেহারা দেখা যাচ্ছে। নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা নানানভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যাহত হলে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ইত্যাদি ক্ষেত্রে। এ ছাড়া সরকার যে ধরনের অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে এগোচ্ছে তাতে যুব বেকারত্ব বাড়ছে। এ রকম অবস্থায় প্রশাসনের যদি সার্বিক উন্নতি না হয় তাহলে অবিচারের নতুন দিক সৃষ্টি হবে। এ মুহূর্তে সংকট সামাল দিতে হবে। তবে ভবিষ্যৎ সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয়া দরকার। 
 

আমদানি নির্ভরতাই বর্তমান বিদ্যুৎ সংকটের কারণ: অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ মূল সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো বসে থাকায় ক্ষতি হচ্ছে। সম্পূর্ণ বসে আছে এমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া ঠিক নয়। বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সাশ্রয় করা ছাড়া আমাদের এখন আর কোনো উপায় নেই। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন তিনি। একইসঙ্গে গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানি জোগান না বাড়িয়ে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হওয়ার কারণে বর্তমানে বিদ্যুৎ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানির জোগান দিতে না পারায় এ সমস্যা হয়েছে। দ্রুতগতিতে বিদ্যুৎ আনার জন্য এক সময় তেলভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। তবে সেটাকে তিন বা পাঁচ বছর পর্যন্ত রাখার পরামর্শ ছিল। কিন্তু সেটা না করে এখন পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া হচ্ছে।

 ফলে তেলের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। আর তেলের ওপর এই নির্ভরতার কারণেই বর্তমান সমস্যা তৈরি হয়েছে। 
বর্তমানে দেশে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে উল্লেখ করে ম. তামিম বলেন, দেশে যেকোনো সময়ে উৎপাদন কমে যেতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে গ্যাস ও তেল আমদানি নিয়ে সংকট তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগে থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বেশি ছিল। যুদ্ধের কারণে দাম আরও বেড়েছে। 
ব্যবসায়ী নেতা মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, আমরা অস্বস্তিতে আছি। এর মূল কারণ গ্যাস সংকট। এই সংকটের সমাধান না হলে রপ্তানিমুখী শিল্প সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং রপ্তানি কমে যাবে। এর ফলে অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status