প্রথম পাতা
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করলো ভারত
আন্তর্জাতিক আইন কী বলছে?
স্টাফ রিপোর্টার ও মানবজমিন ডেস্ক
১০ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার
বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে নেপাল এবং ভুটানের ক্ষেত্রে এই সুবিধা চালু থাকবে। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কারণ হিসেবে দেশটির বিমানবন্দরে পণ্য জটের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যম সম্প্রতি ‘সেভেন সিস্টার’ নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য এবং ঢাকায় চলা বিনিয়োগ সম্মেলন এর বিষয় সামনে এনেছে। বাংলাদেশের খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটা ধাক্কা হবে। আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে। পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ভারতের সরকারি ওই সার্কুলারে বলা হয়েছে, স্থলবন্দর বা বিমানবন্দরগামী ভারতীয় স্থল কাস্টমস স্টেশন ব্যবহার করে বাংলাদেশি পণ্যবাহী কার্গোকে পণ্য পরিবহন করতে দেয়া হবে না। সরকার এরই মধ্যে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। এর আগে বাংলাদেশকে দেয়া এই সুবিধা প্রত্যাহারের জন্য ভারতের রপ্তানিকারকরা, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রপ্তানিকারকরা সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিল। পিটিআই’র খবরে বলা হয়, ভারতের দেয়া এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার কারণে ভুটান, নেপাল এবং মিয়ানমারের মতো দেশে বাংলাদেশ মসৃণভাবে পণ্য রপ্তানি করতে পারতো। ২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশকে এই সুবিধা দেয় ভারত। ৮ই এপ্রিল সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমসের সার্কুলারে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ২৯শে জুনের সার্কুলার বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সংশোধনী অবিলম্বে কার্যকর হবে।
এরই মধ্যে যেসব পণ্যবাহী কার্গো ভারতে প্রবেশ করেছে তাদেরকে ওই সার্কুলারে দেয়া প্রক্রিয়ার অধীনে ভারতীয় অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যেতে দেয়া হবে। ভারতের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা এমন এক সময়ে এলো যখন ভারত ও বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের বিরুদ্ধে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আগের সার্কুলারের অধীনে ইন্ডিয়ান ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনস (এলসিএস) হয়ে ভারতের স্থলবন্দর ও বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের কার্গোকে অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এর অধীনে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানি হতো। বাণিজ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে তৈরি পোশাক, জুতা, জেমস ও অলঙ্কারের মতো ভারতীয় রপ্তানি খাতের সহায়ক হবে। বস্ত্রশিল্পে ভারতের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশন্সের (এফআইইও) মহাপরিচালক অজয় সাহাই বলেন, এখন আমাদের কার্গোর জন্য অধিক পরিমাণ সক্ষমতা পাবো।
অতীতে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার কারণে এক্ষেত্রে স্থান সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ করেছেন ভারতের রপ্তানিকারকরা। ওদিকে তৈরি পোশাকের রপ্তানিকারকদের সংগঠন এইপিসি বাংলাদেশকে দেয়া সুবিধা স্থগিত করার আহ্বান আগেই সরকারের কাছে জানিয়েছিল। কারণ, ওই সুবিধার মধ্য দিয়ে দিল্লি এয়ার কার্গো কমপ্লেক্সের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি বিষয়ক কার্গোকে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এইপিসি’র চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি বলেন, প্রতিদিন দিল্লিতে লোড করা ২০ থেকে ৩০টি ট্রাক এসে পৌঁছে। এর ফলে কার্গোগুলোর মসৃণ চলাচল ধীরগতির হয়ে যায়। ফলে বিমান সংস্থাগুলো অনুচিত সুবিধা নিচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে বিমান ফ্রেইটের ভাড়া। রপ্তানি কার্গোগুলো হস্তান্তর ও প্রক্রিয়াকরণ বিলম্বিত হচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে মারাত্মক জট সৃষ্টি হয়।
থিংকট্যাংক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্স ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, তৃতীয় কোনো দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানি ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সরকারের ওই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বিঘ্নিত হতে পারে। এর আগে বাংলাদেশকে যে ম্যাকানিজম বা সুবিধা দেয়া হয়েছিল তা ব্যবহার করে ভারতের ভেতর দিয়ে রুট ব্যবহার করতে পারতো। এতে ট্রানজিট সময় ও খরচ কম হতো। কিন্তু এখন সেই সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি যৌক্তিকভাবে বিলম্বিত হতে পারে। খরচ বাড়তে পারে। অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের জন্য ট্রানজিট সুবিধা বিধিনিষেধে আটকে দেয়ার ফলে স্থলবেষ্টিত নেপাল ও ভুটান উদ্বেগ জানাতে পারে। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন শ্রীবাস্তব। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, ভূমিবেষ্টিত দেশগুলো থেকে এবং সেখানে পণ্য সরবরাহের জন্য ট্রানজিট সুবিধার স্বাধীনতা অনুমোদিত। এর অর্থ হলো এই ট্রানজিটে কোনো বিধিনিষেধ থাকতে পারবে না। অপ্রয়োজনে বিলম্ব করা থেকে তা মুক্ত থাকতে হবে। উল্লেখ্য, জেনেভাভিত্তিক এই সংগঠনের সদস্য বাংলাদেশ এবং ভারত উভয়েই।
ওদিকে বাংলাদেশের পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত ভারত নিয়েছে, তা নেপাল বা ভুটানগামী পণ্য চালানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলে জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতের স্থলসীমান্ত ও ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভুটান বা নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য হয়, তার ওপর ভারতের নতুন সিদ্ধান্তের কোনো প্রভাব পড়বে না বলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য।
বুধবার সন্ধ্যায় বিষয়টি স্পষ্ট করে এই বিবৃতি দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে উল্লেখযোগ্য পণ্যজট সৃষ্টি হচ্ছিল। এই কারণে আমাদের নিজস্ব রপ্তানিতে বিলম্ব, খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যাকলগ তৈরি হচ্ছিল। ফলে, এই সুবিধা ৮ই এপ্রিল ২০২৫ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্পষ্ট করে বলা যায়, এই সিদ্ধান্ত ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে নেপাল বা ভুটানে পণ্য পরিবহনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।
উল্লেখ্য, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য অবাধ ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়।১৯৯৪ সালে সংস্থাটির জারি করা জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (জিএটিটি)-এর পঞ্চম অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব সদস্যকে স্থলবেষ্টিত দেশগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট দিতে হবে এবং এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সীমা দেয়া যাবে না। তাছাড়া এই পণ্য পরিবহনকে শুল্কের আওতায় ফেলা যাবে না।
ফলে ভারত যদি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে তা ডব্লিউটিওর নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
ওদিকে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারত বাতিল করার সিদ্ধান্ত হতবাক করেছে সংশ্লিষ্ট খাত গবেষকদের। এই সিদ্ধান্ত বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মানবজমিনকে বলেন, কোনোরকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারত বাতিল করার সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছি। বাংলাদেশের সরকারের উচিত এই বিষয়ে দ্রুতই ভারতের কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া। একইসঙ্গে অনুরোধ থাকবে যাতে এই সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখে। তবে প্রতিক্রিয়া হিসেবে যাতে বাংলাদেশ পাল্টা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন এই গবেষক। ভারতের সিদ্ধান্তে কী প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, তুলনামূলকভাবে প্রভাব কম পড়বে। কিছুটা রপ্তানি প্রভাব পড়তে পারে।
পাঠকের মতামত
ভারতকে লীগমাতা হাসিনা যা দিয়েছে, তাহা ভারত চিরজীবন মনে রাখবে। এই তার মনে রাখার নমুনা।
তাহলে বাংলাদেশ ভারত কে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে তাদের অন্নান্য রাজ্যে যে মালামাল পাঠানোর সুবিধা দে সেটা বাতিল করে দিক। ঠেলার নাম বাবাজি তখন বুঝবে।
বাংলাদেশের উচিৎ ট্রানজিট বন্ধ করে দেয়া। বাংলাদেশে শত্রু রাষ্ট্র ভারত যারা কখনো বাংলাদেশ কে মাথা উচু করে দাড়াতে দেবে না।
ভারত যাই ভাবুক না কেন, আমরা ভারতের শত্রু নই । আমরা তাদের প্রতিবেশী, যা পরিবর্তন করা যাবে না! আবেগের বশে তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, তবে ভারতের সাথে ট্রানজিট চুক্তি, বন্দর এবং সড়ক ব্যবহারের ফি যুক্তিসঙ্গতভাবে বৃদ্ধি করা উচিত ।
We don't need your transshipment - we had been doing business before 2020 without transshipment - oil your own machine
Lacking knowledge of bilateral relationship building and consequences.
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিশাল বাণিজ্য সারপ্লাস ! এ বিষয়ে দেশের কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত এখনো গুরুত্ব সহকারে প্রচার হয়নি বলে মনে হয় ।