ঢাকা, ১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৪ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

প্রথম পাতা

রাসেলের মৃত্যুতে স্তব্ধ পরিবার

ফাহিমা আক্তার সুমি
৭ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার
mzamin

রাসেল মিয়া (২২)। ভ্যানগাড়িতে মালামাল বিক্রি করতেন। রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বোনের সঙ্গে বসবাস করতেন। রাসেলের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি। গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চালাকালীন জুমার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এলোপাতাড়ি গুলির মুখে পড়েন। এ সময় একটি গুলি রাসেলের গলার এক পাশে বিদ্ধ হয়ে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। রাসেলের মৃত্যুতে তার বাবা আবুল কাশেম এখন শয্যাশায়ী। রাসেলকে হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন পুরো পরিবারটি। 

কাঁদতে কাঁদতে রাসেলের মা মাকসুদা বেগম মানবজমিনকে বলেন, আমার সন্তান তো নেই আর, তাকে তো গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি তো শেষ হয়ে গেছি। আমার ছেলেটা জুমার নামাজ পড়তে গেল আর ফিরে আসলো না। আমার কোল থেকে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে গেছে। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। রাসেল ছিল সবার ছোট। সে তার বোনের কাছে থাকতো। কাছে হওয়ায় সেখানেই থেকে কাজ করতো। রাসেল যখন সময় পেতো আমাদের কাছে আসতো। মৃত্যুর চারদিন আগেও আমি গিয়ে রান্না করে নিজ হাতে বেড়ে খাইয়ে এসেছি। তিনি বলেন, ওইদিন রাসেল আমাকে বললো, ‘মা রাত দশটা বেজে গেছে আপনি বাসায় যান, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ শুক্রবারও মেয়ের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যাইনি বাইরের পরিস্থিতি খারাপ দেখে। পরে তো ওর মৃত্যুর কথা শুনে যেতে হয়েছে। সোমবার কথা বলে এসেছি আর কথা হয়নি। আমরা ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় থাকি। গ্রামে কোনো সম্পদ নেই। মোহাম্মদবাগে বাসা ভাড়া কম হওয়ায় বড় ছেলের সঙ্গে থাকি। ওর বাবা কয়েকবার  স্ট্রোক করেছে। ছেলে মারা যাওয়ার পর আবার  স্ট্রোক করেছে। আগে হাঁটতে চলতে পারতো এখন কথাই বলতে পারে না, বিছানায় শুয়ে থাকে। আমার রাসেল মাসে কিছু টাকা দিতো আমাদের ও নিজে চলতো। মারা যাওয়ার আগে আমাকে চশমা কিনতে এক হাজার টাকা দিয়েছিল আমি সেই টাকা দিয়ে চশমা কিনেছি। পরে বলেছিল, ‘মা আবার কিছুদিন পর তোমাকে টাকা দিবো।’ ওর বাবাকেও মেডিসিন কেনার টাকা দিতো। যখন যেটা আমাদের প্রয়োজন হয় সেটি দিতো। এখন আমাদের দেখবে কে? আমার সন্তানের মুখটা তো কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাসেলের ভাই হাছান বলেন, ১৯শে জুলাই শুক্রবার রাসেল যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়। প্রত্যেক জুমায় সে এখানের বড় মসজিদে নামাজ পড়তে যেতো। নামাজ শেষে বের হলে তখন এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে পুলিশ। এ সময় রাসেলের গলায় এসে একটি গুলি লেগে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেখানে থাকা শিক্ষার্থীরা তাকে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাসেলের ফোন থেকে আমার বোনকে কল করে ঘটনাটি জানায়। পরে বোন আমাকে জানালে বিকাল চারটার দিকে একসঙ্গে হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি তিনটা লাশের সঙ্গে আমার ভাইকে মর্গে রেখে দিয়েছে। 

হাসপাতাল থেকে ভাইয়ের লাশ বের করতেও বাধা দেয়া হয় আমাদের। রাত দশটা বেজে গেলেও মরদেহ বের করতে দেইনি। একপর্যায়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে নিতে গেলে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা মারধর করে আমাদের। কান্নাকাটি করে মানুষের হাত-পা ধরেছি ভাইয়ের লাশটি যেন দেয়। কোনোমতে পেছনের দরজা দিয়ে রাস্তায় ভাইকে বের করে আনলে আনসার সদস্যরা আবার ভেতরে নিয়ে যায়। পরে অনেক হাতজোড় করে ভাইয়ের লাশ নিয়ে আসি। কোনোমতে রাতে গোসল দিয়ে জুরাইন কবরস্থানে এগারোটার দিকে দাফন করা হয়। তিনি বলেন, আমরা জন্মের আগে থেকেই ঢাকায় থাকি। গ্রামে কোনো জমি-জায়গা নেই। চট্টগ্রাম থেকে আমার পরিবার অনেক আগে ঢাকায় এসেছে। বাবা-ভাইয়ের মৃত্যুর পর বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কথা বলতে পারে না। রাসেল আমাদের সবার ছোট ছিল। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সব ছোট ভাইটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। রাসেল আজ বেঁচে থাকলে তো চোখের সামনে ঘুরতো, দেখতে পেতাম। রাসেল যা আয় করতো পরিবারকে মোটামুটি খরচ দিতো। আমি গাড়ি মেরামতের কাজ করি। ভাইয়ের এমন মৃত্যু কোনো ভাই চায় না। এ পর্যন্ত অনেকে নাম-ঠিকানা নিয়ে গেছে কিন্তু কোনো সুফল পাইনি। কেউ খোঁজখবর রাখছে না। সবসময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, অনেক ভদ্র ছিল। এত অল্প বয়সে আমার ভাইকে হারাতে হলো। 

বোন শিরীন আক্তার বলেন, বাইরের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সে সময় মালামাল বিক্রি করতে যেতে পারতো না। সেদিনও রাসেল বাসায় ছিল। খাবার খেয়ে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিল। ১৮ই জুলাই যাত্রাবাড়ী বড় মসজিদের সামনে একটি ছেলের গায়ে গুলি লাগে। রাসেল তাকে রিকশায় তুলে তার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সেই ছেলেটা সুস্থ হয়েছে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় কিন্তু আজ আমার ভাইটা বেঁচে নেই। এর আগে রাসেল না বলে আন্দোলনে চলে যেতো। আমার ঘর থেকে প্রায়ই গুলির শব্দ শোনা যেতো। রাসেল যেদিন মারা যাবে সেদিন বাইরে যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিল, ‘আপু নামাজ পড়তে যাই।’ আমি ওকে সাবধানে যেতে বলেছিলাম। এটাই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমার নাম্বারে কল করে একজন মৃত্যুর খবর জানায়। পরে আমরা হাসপাতালে গিয়ে মৃত পাই। আমার মা হার্টের রোগী। আর বাবা তো আগে থেকেই অসুস্থ। এখন রাসেলের মৃত্যুর পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না, মনে হয় আমার ভাই পাশে শুয়ে আছে। এখন সবসময় মনে হয় আমার ভাই আমাকে এসে আপু বলে ডাকছে। আমার ভাইয়ের নামটা এখন পর্যন্ত শদীদদের তালিকায় উঠেনি। সরকার যেন আমার ভাইকে শহীদি মর্যাদাটুকু দেন।

পাঠকের মতামত

বিচার করতেই হবে।

জনগণ
৭ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ১২:১৮ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status