শেষের পাতা
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, কোন পথে হাঁটবে দিল্লি?
মানবজমিন ডেস্ক
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক মহলে কড়া আলোচনা অব্যাহত থাকলেও নীতি-নির্ধারকদের দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন আকার দিতে পথ খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ১৩ই সেপ্টেম্বর দ্য উইক ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা সত্য যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (এনই) অন্যান্য দেশের তুলনায় একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। শুধু নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এর প্রভাব গুরুত্ব বহন করে। এক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতির ওপর আলোচনাটি প্রাসঙ্গিক।
সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতন দিয়ে এ আলোচনা শুরু করা যাক। আলোচনাকে বাস্তবতার মধ্যে রাখতে কিছু বিদেশি তত্ত্বকে এড়িয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থান হয়েছে তা কি কোনো ডানপন্থি বা ইসলামপন্থি প্রতিবাদ ছিল, যার মাধ্যমে ছাত্রদের প্রতিবাদকে ঢেকে রাখা হবে? বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝা যায় ছাত্রদের বিক্ষোভ ছিল হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে এই কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তারা এর মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে বৈষম্য দূর করার আওয়াজ তুলেছিলেন।
তবে এই কথা সমানভাবে সত্য যে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোও যোগ দিয়েছিল। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন ভেবে দেখতে হবে যে, সাময়িক বা সার্বিক প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন একটি দেশে শাসকের বিরুদ্ধে যখন বিক্ষোভ চলে সেখানে কী বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক নয়? আসলে, এটা যুক্তিসঙ্গত যে, রাজনীতির সারমর্মই হলো সমাজের বিক্ষুব্ধ অংশগুলোর মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করা। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বা তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিবাদের ঢেউ জাগাটাই স্বাভাবিক।
ভারতীয় গণমাধ্যমও দাবি করে আসছে যে, শেখ হাসিনাকে বিক্ষোভ মোকাবিলায় কার্যকর সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। একটি বিষয়ে সামপ্রতিক সময়ের বাংলাদেশি সামাজিক-রাজনৈতিক দৃশ্যপটের প্রশংসা করতে হবে। বিক্ষোভের আগেও যেমন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাব বেশ স্পষ্ট ছিল। ঠিক তেমনি এখনো বাংলাদেশে একই অবস্থা বিরাজ করছে। যখন ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ভারতের বহিরাগত গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করা হয় তখন বুঝতে হবে সে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা কতটা প্রকট। এটাও সত্য যে, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা এই ভারত-বিরোধী আখ্যান গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হলেও ভারতের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক নীতিও বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারত-বিরোধিতার জন্য সমানভাবে কাজ করেছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে, প্রতিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাবেক সরকারকে সহায়তা করার জন্য ভারত মূল্যবান কিছু করতে পারতো।
ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই বুঝতে পেরেছে যে, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে স্বতন্ত্র সম্পর্কের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। যদিও উভয়পক্ষের রাজনীতিবিদ এবং গণমাধ্যম তাদের বক্তব্য অব্যাহত রেখেছে। তবে স্থিতিশীলতার জন্য দু’দেশের কূটনীতিক এবং নীতি-নির্ধারকদের সম্পর্ককে নতুন আকার দেয়ার জন্য পথ খুঁজে বের করতে হবে। এটি করতে গিয়ে, ভারতকে চারটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যা সমপ্রতি সোসাইটি টু হারমোনাইজ অ্যাস্পিরেশন ফর রেসপনসিবল এনগেজমেন্ট’র (এসএইচএআরই) বিশ্লেষণে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে যদি দিল্লি যতদিন খুশি ভারতে থাকার অনুমতি দেয় তাহলে নিঃসন্দেহে তা ঢাকার বর্তমান সরকার এবং বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের বিরক্তির কারণ হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা করতে না চাইলেও, শান্তি ও নিরাপত্তা ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে অর্জিত হতে পারে না- তা দেখানোর জন্য বহু উদাহরণ রয়েছে। তদুপরি, ভারত-বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার মূল ভিত্তি যখন উভয় দেশের সম্পৃক্ততা, তখন ভারতকে মনে রাখতে হবে যে, তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য ভারত-বিরোধী উপাদানগুলো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। সর্বশেষ, যখন দিল্লি ঢাকার সঙ্গে একটি জাতীয় নীতি অনুসরণ করবে সেটা যেন আগরতলা, আইজল, দিসপুর এবং শিলংকে কেন্দ্র করে নেয়া হয়।
এখন ভারতীয় গণমাধ্যম এবং রাজনীতিবিদরা যদি গলাবাজি বন্ধ করে তাহলে সেটা নিজ দেশের জন্য একটি মহান সেবা হতে পারে। এক্ষেত্রে এই পরিস্থিতিতে সঠিক নীতির জন্য বিকল্প বাস্তবিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা জারি রাখতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন বাঁক উপলব্ধিই এখন ভারত-বিরোধিতা সমাধানের সঠিক জবাব। দিল্লি ঢাকার সঙ্গে তার সম্পর্ক করতে চাইলে গণভবন বা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার রাজনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে সম্পর্ক করলে চলবে না। এক্ষেত্রে দিল্লিকে অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে।
পাঠকের মতামত
ভারত তাঁর সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার ঝুঁকি বুঝেশুনেই নিয়েছে। ভারত যে ভাবে আন্তর্জাতিক এবং আভ্যন্তরীণ বিষয়ে শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করছিল, তাতে তাঁদের বিশ্বাস করার কোন কারণ ছিল না যে, পুঁচকে একটি আন্দোলন এমন পর্যায়ে চলে যাবে! আর তাতে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে! ভারত কিছু সংগত কারণেই বিএনপিকে পছন্দ করে না। তাঁরা এখনো আশা করছে রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হলে হাসিনা অন্য কোন রাজনৈতিক দল বা কোন একটা এ্যলিমেন্টের সহায়তায় টুক করে বাংলাদেশে ঢুকে যাবে! এই লক্ষ্যে ভারত কাজ করছে! যদি এই পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় এবং সত্যি সত্যি হাসিনার বিচার শুরু হয়, তখন ভারত হাসিনাকে ফেরত দেবে কিনা এই বিষয়টির উপর নির্ভর করবে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা কে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নাই। গত ১৫ বৎসরের আওয়ামী দুস্বাশন বাংলাদেশের জনগনকে শুধু তাদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সংকিতই করে তোলেনাই, একই সাথে হাসিনার ভারতের প্রতি অতি ভক্তি ও নতজানুতার নীতি বাঙ্গালীর অহংবোধকেও আঘাত করেছিল। ভারতের এর ১৬ আনা ফায়দা নিয়ে হাসিনা সরকারকে অন্ধভাবে সমর্থন করে গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের এই সমর্থনের কারনেই হাসিনা ১৫ বৎসর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে টিকে থাকতে পেরেছিল। সে কারনে হাসিনা শাসনের সকল নেতিবাচক কারনের জন্য আমরা ভারতকে দায়ী করি, কারন ভারতের সমর্থনের কারনেই হাসিনা বাংলাদেশে রাতের ও ডামি নির্বাচন করেও পার পেয়েছিল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ধ্বংস করে টিকে ছিল, পুলিশি রাষ্ট্রে পরিনত করেছিল। ভারত শুধুই তার স্বার্থ দেখছিল - এটা স্বাভাবিক কিন্তু যখন একটি কারচুপির সরকারকে আপনি ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবেন এবং ফায়দা নিবেন তখন তার সকল কর্মকান্ডের দায়-দ্বায়িত্ব আপনার ওপরেও বর্তাবে। যে কারনে আজকে বাংলাদেশে ভারত বিরোধি মতবাদ চরম পর্যায়ে বিরাজ করছে। পানি বর্ডার নিয়ে ভারতের কর্মকান্ডও আমাদের ভারতে ওপর বিরক্ত সৃষ্টি করেছে এবং করছে কিন্তু এগুলো একটা চলমান বিষয়, গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে বিগত ১৫ বৎসর হাসিনাকে দিয়ে আমাদের ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে এবং দেশ ও জাতির যে ক্ষতি করা হয়েছে তার জন্য আমরা আওয়ামী লীগ ও ভারত কে সমান ভাবে দায়ী করি। ভারত বাংলাদেশ বলতে আওয়ামী লীগ’কে বুঝে, তারা বাংলাদেশের জনগনকে বুঝে না। বাংলাদেশের জনগনের মননকে চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছাকে আওয়ামী লেন্সে দেখে। তাই তাদের নেরেটিভে আওয়ামী ছাড়া বাংলাদেশে সবাই ইসলামী, সবাই তালিবান আর ভারত বিরোধী! ভাবতেই অবাক লাগে ভারতের মত একটি ঐতিয্যবাহী সংস্কৃতির দেশের রাষ্ট্র যন্ত্র কিভাবে এতো সংকীর্ণ মানা, এক পেশে হতে পারে। ভারত যত শীঘ্র এই নেরেটিভ থেকে বেরিয়ে আসবে, ভারত- বাংলাদেশের সম্পর্ক তত তাড়া তাড়ি স্বাভাবিক ও দুপক্ষের জন্যই ফ্রুটফুল হবে। ভাটির দেশ বাংলাদেশ এখানে পাহাড় মরুভূমির রুক্ষতা পাবেন না - বাঙ্গালীর ভালবাসায় সরলতা ও স্বচ্ছতা পাবেন।